নারীলোভী, ভণ্ড, প্রতারক অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার মতো শিক্ষক নামের কলঙ্কের মুখোশ উন্মোচন করে নুসরাত যে কালজয়ী ইতিহাস সৃষ্টি করে গেলেন, তা বাংলার নারীসমাজ চিরদিন স্মরণ রাখবে। স্মরণ রাখবে এদেশের প্রতিবাদী প্রগতিশীল মানুষ। নুসরাত জাহান রাফি এ যুগের প্রীতিলতা, ইলা মিত্র ও মালালা ইউসুফ জাইয়ের মতো প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। মৃত্যুকে তিনি ভয় পাননি। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। মৃত্যুর আগেও তিনি সূর্যের মতো মাথা উঁচু করে লিখেছেন, ‘আমি লড়ব শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। আমি প্রথমে যে ভুল করেছি আত্মহত্যা করতে গিয়ে, সে ভুলটা দ্বিতীয় বার করব না। মরে যাওয়া মানেই তো হেরে যাওয়া। আমি মরব না। আমি বাঁচব। আমি তাকে শাস্তি দেব, যে আমায় কষ্ট দিয়েছে। আমি তাকে এমন শাস্তি দেব যে তাকে দেখে অন্যরা শিক্ষা নেবে।’ তার এই সাহস ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
আজ বার বার মনে পড়ছে সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত কবিতার ক’টি লাইন। শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস; অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ; একই হাসি মুখে বাজিয়েছি বাঁশি, গলায় পড়েছি ফাঁস, আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হলো ইতিহাস। ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিমানী ছাত্রী অরিত্রির মতো আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়নি নুসরাত জাহান রাফি। সে তার মর্মান্তিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে গেছে আমাদের বিবেকের বাসভবনে। প্রতিবাদের সেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে ফেনীর সোনাগাজী থেকে রাজধানী ঢাকা হয়ে সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
সিরাজ-উদ-দৌলার হাতে যৌন হয়রানির পর সহপাঠী বান্ধবীদের উদ্দেশে নুসরাতের আবেগঘন একটি চিঠি তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। বান্ধবী তামান্না ও সাথীকে উদ্দেশ করে লেখা চিঠিতে ২৭ মার্চের পৈশাচিক যৌন হয়রানির বিবরণ পাওয়া যায়। চিঠিতে নুসরাত লেখেন- তামান্না, সাথী। তোরা আমার বোনের মতোই, বরং বোনই। ওইদিন তামান্না আমায় বলেছিল, আমি নাকি নাটক করতেছি। তোর সামনেই বলল। আরো কী বলল। আর তুই নাকি নিশাতকে বলেছিলি, আমরা খারাপ মেয়ে। বোন, প্রেম করলে কি সে খারাপ? তোরা সিরাজ-উদ-দৌলা সম্পর্কে সব জানার পরও কীভাবে তার মুক্তি চাইছিস? উনি আমার কোনো জায়গায় হাত দিয়েছে আর কোনো জায়গায় হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছে। উনি আমায় বলতেছে, ‘নুসরাত ঢং করিস না। তুই প্রেম করিস না? ছেলেদের সাথে প্রেম করতে ভালো লাগে। ওরা তোরে কী দিতে পারবে? আমি তোরে পরীক্ষার সময় প্রশ্ন দেব।’
২৭ মার্চ সোনাগাজীর নিজ মাদরাসার প্রভাবশালী অধ্যক্ষ নুসরাতকে কক্ষে ডেকে নিয়ে এসব কুৎসিত ঘটনা ঘটান। সাহসী মেয়েটি এই অন্যায় যৌন নির্যাতন মেনে নেয়নি। তিনি পরিবারকে জানান। মেয়েটির মা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর ৬ এপ্রিল ঘটে সবচেয়ে নৃশংস ঘটনা। মাদরাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে আসেন নুসরাত। পরীক্ষা শুরুর আগে মিথ্যা কথা বলে কৌশলে হল থেকে ছাদে নিয়ে যাওয়া হয় নুসরাতকে। বোরকা, নেকাব আর হাতমোজা পরিহিত চারজন নুসরাতকে চাপ দেয় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে। নুসরাত এতে অস্বীকৃতি জানায়। তাকে হাত-পা বেঁধে তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে ও আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় অধ্যক্ষের লেলিয়ে দেওয়া ওই চার দুর্বৃত্ত। সারা শরীরে লেলিহান আগুনের শিখা নিয়ে নিচে নেমে আসেন নুসরাত জাহান। ওইদিনই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তার শরীরের ৮০ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নুসরাতকে বাঁচাতে সিঙ্গাপুরে উন্নত চিকিৎসার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম। তার শরীরের অবস্থা বিমানে করে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুকূল ছিল না। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে মরণ যন্ত্রণাকাতর নুসরাত বলেন, ‘আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলব। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলব। সারা দুনিয়ার কাছে বলব। এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করব।’ মৃত্যুর সঙ্গে চার দিন লড়াই করে অবশেষে ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টায় সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান নুসরাত জাহান।
১১ এপ্রিল বিকাল পাঁচটা আট মিনিটে নুসরাতের লাশ সোনাগাজীর চরচান্দিনা এলাকার বাড়িতে পৌঁছার পর সেখানে এক হূদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। তার মা শিরিন আক্তার ও ছোট ভাই রায়হান বার বার মূর্ছা যান। এ সময় হাজার মানুষের বিলাপে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। নুসরাতের মৃত্যুর খবর ১০ তারিখ রাতেই ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে তার বাড়ির আশপাশের এলাকায় তিলধারণেরও ঠাঁই ছিল না। হাজার হাজার শোকার্ত মানুষকে সামলাতে উপজেলার মোড়ে মোড়ে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করতে হয়। তার প্রিয়তম বাবা এ কে এম মুসা মিয়া মেয়ের লাশ কাঁধে বহন করেন। মেয়ের জানাজায় নিজেই ইমামতি করেন। ১১ এপ্রিল সন্ধ্যায় পারিবারিক কবরস্থানে দাদির কবরের পাশে দাফন করা হয় নুসরাতের অগ্নিদগ্ধ লাশ। এর আগে এক আবেগঘন বক্তৃতায় বাবা মুসা মিয়া বলেন, ‘আমাদের মতো কোনো বাবা-মায়ের কোল যেন এভাবে খালি না হয়।’ তিনি এ নৃশংস ঘটনার বিচার দাবির পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, হাসপাতালের চিকিৎসক ও গণমাধ্যমের কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
নুসরাতের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। এর আগে তিনি নুসরাতের সম্ভাব্য সর্বাত্মক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী নুসরাত হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেন। নুসরাতের মতো আমারও একটি মেয়ে আছে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। সে তার সহপাঠীদের সঙ্গে সকালে বিদ্যালয়ে যায়। যতক্ষণ বিদ্যালয়ে থাকে, ততক্ষণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই তাদের অভিভাবক ও মাতা-পিতার মতো। নুসরাতের কথা মনে হলে আমি শিহরিত হয়ে উঠি। ভয়ে কেঁপে ওঠে আমার বিষণ্ন বুক। অশ্রু আটকে রাখতে পারি না। নারী নির্যাতনের এই দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেকে বড় অপরাধী বলে মনে হয়। ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হয়। মানুষ কতটা পশু হলে বাপের বয়সী একজন শিক্ষক ১৮ বছর বয়সী নুসরাতের শ্লীলতাহানি করতে পারে।
বন্ধু মোশারফ হোসেন মুসা ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, দিনাজপুরের ইয়াসমীন হত্যার মতো সারা দেশে নুসরাত জাহান হত্যার বিরুদ্ধে কঠোর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমিও তার সঙ্গে সহমত পোষণ করি। নুসরাত জাহানের রেখে যাওয়া প্রতিবাদের পতাকা হাতে নিয়ে সারা দেশের ছাত্র-শিক্ষকসহ সব পেশার সচেতন ও বিবেকমান মানুষকে নিয়ে নারী নির্যাতন, অগ্নিসন্ত্রাস, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ও অপহরণের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তনুর মতো তদন্তের ধূম্রজালে যেন নুসরাতের ঘটনাটি আধারে অতল গহবরে হারিয়ে না যায়, সে বিষয়েও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রাখতে হবে সুতীক্ষ্ন দৃষ্টি। ফেসবুক পেজে আরেক বন্ধু মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান লেখেন, শরীরের ৭৫ শতাংশ দগ্ধ যন্ত্রা নিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেল নুসরাত। খুনি এই ভণ্ড মোল্লা ও তার সহযোগীদের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল করে ফাঁসিতে ঝুলানো হোক। কবি সাব্বির রেজা এক ছড়ায় লেখেন, অভিমানেই চলে গেলে/ মা-মণিটা তুমি, তোমার জন্য কাঁদছে সবাই/ কাঁদছে স্বদেশ ভূমি। এ কান্না শুধু চোখের জলে সীমাবদ্ধ না থেকে জলোচ্ছ্বাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে প্রবল বেগে বাংলাদেশের হূদয়-সুমদ্রে।
লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড
হবঃধরৎড়ু১৮—ুধযড়ড়.পড়স