শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ এবং দেশের কর্ণধার এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সন্দেহ এবং শঙ্কা কেবল প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে। বাবা-মা বড় ধরনের পাপকার্য করলে প্রতিবন্ধী সন্তান অভিশাপ হয়ে জন্মগ্রহণ করে এমন ভয়াবহ ভাবনাও আমাদের সমাজে ঘুরপাক খায়। যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে, তবুও অজ্ঞতার কারণে অধিকাংশ মানুষ নিজেদের ধারণাকে আজো বদলাতে পারেনি বরং কালক্রমে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন ভাবনাই ঠাঁই করে নিয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আইন ও নৈতিক দিক থেকে এমন শিশুদের অধিকার এবং তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব নিয়ে আমি কিছু কথা বলতে চাই। প্রথমত, অনেকেই মনে করেন প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়াশোনার দরকার নেই কিংবা তারা পড়াশোনায় ভালো করতে পারবে না। দুই হাত এবং একটি পা না থাকা সত্ত্বেও একটি মাত্র পা দিয়ে লিখেই ২০১৯ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে মানুষকে অবাক করে দিয়েছেন যশোরের তামান্না আক্তার নূরা। যারা মনে করেন প্রতিবন্ধী শিশুরা পড়াশোনায় ভালো করতে পারবে না তাদের চিন্তাকে বদলে দিতে এর থেকে চমৎকার উদাহরণ আর কী হতে পারে! তা ছাড়া উচ্চশিক্ষায়ও তাদের ঈর্ষণীয় বিচরণ লক্ষণীয়। মেডিকেল ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অসংখ্য তুখোর মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছে যারা সমাজে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণার দেয়াল টপকে জীবন গড়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে লড়াই করে প্রতি মুহূর্তে। আমি তাদের স্যালুট করি। এ ধরনের শিশুদের জীবনে প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করা যতটা কষ্টের তার থেকে শতগুণ বেশি কষ্টের সমাজের মানুষের দ্বারা ভ্রান্ত ধারণার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা এবং তাদের নিরুৎসাহিত করা। আমাদের সমাজ ভুলে যায় সুস্থ শিশুদের মতো এদেরও মৌলিক অধিকার রয়েছে এবং এদের মাঝেও অপার সম্ভাবনা ও প্রতিভা লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু তাদের সে সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত করতে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের তৎপরতা অপর্যাপ্ত। তাই তারা নিজেদের বিকশিত করতে পারে না আর এ ব্যর্থতা তাদের নয় বরং সমাজ, রাষ্ট্র এবং আমাদের। যদি কন্যাশিশু কোনো পরিবারে প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করে তাহলে সে শিশু এবং তার পরিবারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কারে আচ্ছাদিত সমাজ ঐ পরিবারকে জীবিত দাফন করে দেয়। যদিও জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের (সিআরসি) ২৩ ধারা অনুযায়ী, অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর মতো প্রতিবন্ধী শিশুরাও সমানাধিকার ও সমসুযোগ পাওয়ার অধিকারী এবং ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’-এ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তবুও আমাদের দেশের বাস্তবতার আশানুরূপ পরিবর্তন হচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে আমরা মনে করি প্রতিবন্ধী শিশুদের দ্বারা কিছুই হবে না। তাই প্রথমেই তাদের আমরা বাতিলের তালিকায় ফেলে রাখি অর্থাৎ আমরা ভুলেই যাই রত্ন পেতে যত্ন করতে হয়।
প্রতিবন্ধী শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে অন্য শিশুদের থেকে আলাদা থাকে তাই তাদের বেড়ে ওঠার জন্য বিশেষায়িত পরিবেশ দরকার। শিক্ষার জন্য এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দরকার যেখানে তারা সহজেই খাপ খাওয়াতে পারবে। এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রয়োজন যাতে প্রতিবন্ধী শিশুদের মন-মানসিকতা বুঝে পাঠদান করতে পারে। তাদের সুস্বাস্থ্য এবং বিনোদনের জন্য আলাদা খেলার মাঠ এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, যেখানে তারা মানসিক বিকাশের জন্য সুষ্ঠু সংস্কৃতি চর্চা করতে পারবে। তা ছাড়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে টিকে থাকতে তাদের তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় সুবিধা সৃষ্টি করাও জরুরি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের একটি পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশে মোট প্রতিবন্ধী শিশু ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৪৪৬ জন। বাংলাদেশের উন্নয়নে এ বিশাল পরিমাণ শিশুকে মূল ধারার সাথে সম্পৃক্ত করে মানবসম্পদে রূপান্তর করার বিকল্প নেই। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান সরকার বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন এনজিও প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষায়িত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। এ কার্যক্রমটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন বাস্তবায়ন করে থাকে। এসব বিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে-সুইড বাংলাদেশ পরিচালিত ৪৮টি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন পরিচালিত ৭টি ইনক্লুসিভ বিদ্যালয় এবং বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বিদ্যালয়। তবে চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম হওয়ায় এখনো সিংহভাগ প্রতিবন্ধী শিশু তাদের যথাযথভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের দুর্বার অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধী শিশুরা যাতে ভবিষ্যতে জাতির জন্য বোঝা না হয়ে দেশ ও জাতির সম্পদ হতে পারে সেজন্য সরকার আরো কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমি আশাবাদী। এ ছাড়া আইন ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের পাশাপাশি প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ববোধও অপরিহার্য। প্রতিবন্ধী শিশুদের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি করে এমন শব্দ যেমন পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, অন্ধ বলে সম্বোধন না করা। তাদের অনুপ্রাণিত করা এবং নেতৃত্বগুণ অর্জনে সামাজিক যে-কোনো কাজে তাদের অংশগ্রহনের সুযোগ দেওয়া। এমন শিশুদের বাবা-মাকে নিরুৎসাহিত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন কিংবা এনজিও বিভিন্ন সেমিনার করে এমন শিশুদের বাবা-মাকে বোঝাতে পারে কীভাবে ধৈর্যের সঙ্গে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রয়োজন বুঝতে হয় এবং সন্তানের প্রতিবন্ধিকতা জয় করে জীবনে সফল হতে সহায়তা করতে হয়। কোথাও প্রতিবন্ধী শিশুরা নির্যাতন কিংবা শোষণের শিকার হলে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। পরিশেষে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিবন্ধী শিশুরা তাদের প্রতিবন্ধকতা জয় করে দেশ ও জাতির জন্য ঈর্ষণীয় সাফল্য ছিনিয়ে আনবে এমনটাই প্রত্যাশা।
মুহম্মদ সজীব প্রধান
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।