শিখন পদ্ধতি ও আমাদের শিক্ষাবিষয়ক আলাপ

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

শিক্ষাচিন্তা

শিখন পদ্ধতি ও আমাদের শিক্ষাবিষয়ক আলাপ

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ৫ এপ্রিল, ২০২১

একজন বয়স্ক মানুষ তার সমস্ত জ্ঞান, সার্টিফিকেট ও ডিগ্রি নিয়ে শ্রেণিকক্ষের সামনে কিংবা শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেই কি শিক্ষার্থীদের মধ্যে তার জ্ঞান পরিচালিত হবে? একজন বয়স্ক ও জ্ঞানী শিক্ষক যদি শ্রেণিকক্ষে কিছু না করে শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন কিংবা বসে থাকেন তাহলে তিনি কি তাদের কিছু শেখাতে পারবেন? উত্তর  স্বভাবতই ‘না’ হবে। শিক্ষার্থীদের কোনো ধারণা দিতে হলে, কিছু বোঝাতে হলে তাকে কিছু না কিছু করতে হয়। তাকে কিছু পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয়, যাতে তার ভেতরকার জ্ঞান তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন। তিনি নিজে অ্যাকটিভ হবেন, শিক্ষার্থীদের অ্যাকটিভ করাবেন এবং তাদের কিছু কাজ করতে দেবেন, তাহলেই শিক্ষার্থীরা তার ভেতরকার জ্ঞান ও বুদ্ধির কিছু অংশ নিজেদের মধ্যে পরিবাহিত করতে পারবে। এই যে পদ্ধতিগুলো একজন বয়স্ক মানুষ শিক্ষার্থীদের সামনে তাদের জন্য ব্যবহার করেন সেই পদ্ধতিগুলোই হচ্ছে পেডাগজি। এটি আশা করা যাবে না যে, একজন শিক্ষকের কথা শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু ছাড়াই সহসা শুনবে, মনোযোগ দেবে, বোঝার চেষ্টা করবে কিংবা বুঝবে এবং কাজ করবে। আর যে পদ্ধতি এবং কৌশল বয়স্কদের শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করে সেই পদ্ধতি এবং কৌশলকে বলা হয় অ্যান্ড্রাগজি। তাহলে দেখা যায় পেডাগজি হচ্ছে এমন শিক্ষা পদ্ধতি যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের পরিচালনা, মূল্যায়ন এবং জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ওপর নির্ভরশীল থাকে। পেডাগজি এবং অ্যান্ড্রাগজি দুটোই এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে। পেডাগজি পেইডি (ঢ়ধরফর) এবং অ্যাগো ধমড় থেকে এসেছে। পেইডি হচ্ছে শিশু আর অ্যাগো হচ্ছে গাইড বা পরিচালক। অ্যান্ড্রাগজি অ্যান্ডাস ধহফৎধং যার অর্থ হচ্ছে মানুষ এবং অ্যাগো মানে গাইড বা নিদের্শক শব্দ দুটো থেকে এসেছে। তবে দুটে শব্দই শিখন কৌশল নিয়ে কথা বলে।

পেডাগজিতে শিক্ষার্থী শিক্ষকের ওপর নির্ভর করে। এখানে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি যাচাই করেন। তিনি পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে শিক্ষার্থীদের যা পড়ানো হয়েছে তার কার্যকারিতা ও ফলপ্রসূতা বোঝার ও জানার চেষ্টা করেন। আর অ্যান্ড্রাগজির বেলায় শিক্ষার্থী নিজেই নিজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এখানে শিক্ষার্থী স্বমূল্যায়ন এবং স্বপরিচালনা করেন এবং নিজেই পদ্ধতির পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে শেখার কাজে ব্যবহার করেন। কারণ হচ্ছে এখানে শিক্ষার্থীরা বয়স্ক। অতএব তাদের জানার, শেখার ধরন ও কারণ শিশুদের জানার কৌশল থেকে আলাদা। পেডাগজির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা বাইরের কোনো উৎস থেকে প্রেষণা অনুভব করে, যেমন বাবা-মা কিংবা শিক্ষক। কৃতকার্য ও অকৃতকার্যতার মধ্য দিয়ে কোনো কাজ শেষ হয়। আর অ্যান্ড্রাগজির ক্ষেত্রে নিজস্ব ও ভেতরকার প্রেষণা দিয়ে পরিচালিত হয়। যেমন আত্ম-সম্মান, আত্মমর্যাদা, সমস্যা সমাধান এবং স্বীকৃতির বিষয় জড়িত আর কোনো কাজ শেষ হয় পাণ্ডিত্য অর্জনের মধ্য দিয়ে। এখানে পাস-ফেলের বিষয় খুব একটা কাজ করে না। বয়স্করা স্বপ্রণোদিত হয়ে শেখে। তারা পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগায় শিখনের উপাদান হিসেবে। সামাজিক ভূমিকার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিষয় হলে বয়স্করা কোনো কিছু শিখতে বেশি মোটিভেটেড হয়। তারা কোনো সমস্যার সমাধান শিখতে পছন্দ করেন, যা তারা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারেন এবং তারা আন্তপ্রেষণা নির্ভর অর্থাৎ তাদের মোটিভেশন আসে ভেতর থেকে কোনো কিছু শেখার ক্ষেত্রে। তাই বলা হয়ে থাকে, শিশুরা যেভাবে শেখে বয়স্কদের ক্ষেত্রে সেভাবে শেখানোর চেষ্টা কাজে লাগে না। আর এজন্যই শিখন বিষয়টি কীভাবে ঘটে সেটি আমাদের  জানা ও বোঝা খুব জরুরি। পেডাগজি হচ্ছে শেখানোর পদ্ধতি ও শেখানোর কৌশল বা শেখানোর পদ্ধতিবিষয়ক বিজ্ঞান যা বয়স্কদের শেখার পদ্ধতি থেকে আলাদা। আমরা যারা শিক্ষক তারা অনেকে মনে করি আমি একটি বিষয় এভাবে শিখছি, আগ্রহভরে শিখছি শিক্ষার্থীরা সেভাবে শিখছে না কেন। আসলে তারা আমাদের মতো করে শিখবে না। এই বিষয়টির সাথেই আমাদের পরিচয় ঘটাতে হবে।

বিদ্যালয়ে এক ধরনের পরিবেশ বিরাজ করে। এমন একটি পরিবেশে  শিক্ষার্থীরা  বসে কিংবা অবস্থান করে যেখানে বাধ্য হয়েই তাদের কিছু শিখতে হয়, কোনো একটি বিষয় শিখতে হয়। বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষে অনেক শিক্ষার্থীরা একসাথে বসে যারা মোটামুটি সমবয়সি, প্রায় একই জাতীয় এবং একই অভিজ্ঞতা নিয়ে বসে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য মোটামুটি এক, আর সেটি হচ্ছে অধিকাংশ সময়ই এখানে তারা ব্যয় করবে কিছু শেখার জন্য। এখানকার অধিকাংশ মোটিভেশনই হচ্ছে বাইরের অর্থাৎ এখানে তারা তাদের বাবা-মা, কিংবা শিক্ষকদের খুশি করার জন্য ক্লাসে এসেছে। এক ধরনের পরিবেশ এবং অবস্থা তাদের বাধ্য করছে এখানে এসে এভাবে কিছু শিখতে। তারা পূর্ণবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত শেখার মূল্য সম্পর্কে অতটা অবগত থাকে না। পুরো বিষয়টিই অনেকটা বাধ্যবাধকতার মতো। তবে যখন তারা গ্র্যাজুয়েট হয় অর্থাৎ পাস করে বেরিয়ে যায় তখন ঘটনা আলাদা। তখন তাদের জানা ও শেখার কৌশল ভিন্ন হয়ে থাকে। বয়স্করা কোনো কিছু শেখেন সেটি মূল্যায়িত হওয়ার  জন্য। যেমন আমরা কোনো একটি হবি বা পছন্দের কাজ বেছে নিই। কারণ হচ্ছে আমরা এর মাধ্যমে প্রশান্তি অর্জন করতে চাই কিংবা এটি করতে আসলেই মজা লাগে, যা মূল কাজগুলো আরো বেশি করতে সহায়তা করে। কিংবা আমরা কোনো একটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে চাই। কারণ সেটি করা হলে চাকরি জীবনে সুবিধা পাওয়া যাবে। আমাদের উচ্চাশা, আমাদের আগ্রহ নতুন কিছু জানতে সাহায্য করে। আর শিক্ষার্থীরা শেখে তাদের পাস করতে হবে। কারণ তাদের ওপর সকলের চাপ আছে—শিক্ষকের, অভিভাবকের, প্রতিষ্ঠানের। এই বিষয়গুলোই হচ্ছে পেডাগজি ও অ্যান্ড্রাগজির মধ্যে পার্থক্য।

বাচ্চাদের জানা বা শেখা হচ্ছে জ্ঞানার্জনের মূল বিষয়কে নির্দেশ করে এবং এটি সূক্ষ্মতর চিন্তন দক্ষতা অর্জন করতে সহায়তা করে। বয়স্কদের ইতোমধ্যে জীবন দক্ষতা অর্জিত হয়েছে জ্ঞানের ভিত্তি তৈরি হয়েছে যেটি নিয়ে তারা এখন শিখতে এসেছেন। তারা ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণে এবং প্রয়োজনের তাগিদে সর্বদাই শিখতে চায়। শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে কিন্তু  পছন্দ নেই অর্থাৎ তারা ইচ্ছে হলে পড়বে, ইচ্ছে না হলে পড়বে না এ বিষয়টি তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাদের সিলেবাস, কারিকুলাম বড়রা তৈরি করে দিয়েছেন, সেখানে যেভাবে আছে শিশুদের সেগুলোই পড়তে হয়। তারা কেন পড়ছে বা কেন পড়তে হবে সেরকম বোঝা বা জানার খুব একটি সুযোগ নেই। বয়স্করা কিন্তু জানেন তারা কেন কোনো বিষয় শিখছেন বা পড়ছেন। অতএব তাদের মোটিভেশন লেভেল অনেক ওপরে। গত শতকে বয়স্ক শিক্ষার যত থিউরি আবিষ্কৃত হয়েছে  সেগুলোর মধ্যে একটি থিউরি ছাড়া বাকি সবাই বলেছেন যে, বয়স্করা ঠিক এভাবেই এবং কারণেই শেখেন।

আচরণবিদরা বলছেন, শিক্ষার্থী নতুন-পুরাতন সব তথ্য একত্রিত করে সার্বিক উপায়ে জ্ঞান আহরণ করে। তারা তথ্য গ্রহণ, প্রসেসিং এবং  নতুন জ্ঞানের সাথে সজ্জিত করে পরবর্তীসময়ে আরো ভালোভাবে স্মরণ করার নিমিত্তে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা নিজেরাই সচল ও কর্মঠ অংশগ্রহণকারী। কনস্ট্রাকটিভিজম বা গঠনবাদ অনুযায়ী  শিক্ষকের থেকে শিক্ষার্থীর ভেতর জ্ঞান সঞ্চারিত হয় না, বরং একজন শিক্ষার্থীই তাদের জন্য অর্থবোধক অধ্যায় তৈরি করে। গঠনবাদে আরো বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান আহরণ করে। এটি তাদের জ্ঞান উন্নয়ন করার ক্ষেত্রে একটি ইঞ্জিন যেখানে পুরনো তথ্য নতুনের সাথে সংযোজন করে প্রসঙ্গের সাথে মিলিয়ে দেয়। নিজেদের সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলো প্রসঙ্গের সাথে মিলিয়ে নতুন তথ্য তৈরি করে। এখানে শিক্ষকরা শুধু ফেসিলিটেটর অর্থাৎ পরিচালনার ভূমিকা পালন করেন। আলবার্ট বান্দুরা সত্তর দশকে ‘সামাজিক শিখন ফর্মুলা’র কথা বলেন যেখানে জ্ঞানীয়তা ও আচরণবাদ সংযুক্ত। ‘সামাজিক শিখন ফর্মুলা’ অনুযায়ী বয়স্করা তথ্য সংগ্রহ করেন অর্থাৎ শিক্ষা গ্রহণ করেন তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার সাথে।

একজন শিক্ষক হিসেবে আমাদের পেডাগজি ও অ্যান্ড্রাগজি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে, তা না হলে আমরা নিজেরা সেভাবে শিখি শিক্ষার্থীদেরও সেভাবে শেখানোর চেষ্টা করব যা আসলে শিশু শিক্ষাদানের পরিপন্থী।

লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

masumbillah65@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads