পিরিয়ড কোনো ‘ট্যাবু’ নয়

মাসিক চলাকালে পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

ছবি : ইন্টারনেট

ফিচার

পিরিয়ড কোনো ‘ট্যাবু’ নয়

  • প্রকাশিত ১২ জুলাই, ২০১৮

ডা. মানসী সাহা

মাসিক, পিরিয়ড, রজঃস্রাব, ঋতুঃস্রাব যে নামেই ডাকা হোক না কেন একটা মেয়ের জীবনের অতি স্বাভাবিক একটা ঘটনাকে কীভাবে জানি একটা অস্বাভাবিক ইতস্ততার চাদরে মুড়িয়ে রাখা হয়। একটা মেয়ের বয়ঃসন্ধিকালের প্রথম ধাক্কাটা খায় এই মাসিক শুরু হওয়ার মাধ্যমে, পড়ে যায় একটা সমাজের তৈরি কারাগারের মধ্যে। এই সময়ে ওমুক কাজ করা যাবে না, ওখানে যাওয়া যাবে না ইত্যাদি। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। প্রাকৃতিক একটা প্রক্রিয়াকে অপ্রাকৃতিক বানানোর দায় আমাদের অজ্ঞতার।  

পিরিয়ডটা আসলে কী? প্রতিমাসে একটা মেয়ের শরীরে একটা চক্র ঘটে যাকে বলে রজঃচক্র (Menstrual cycle)। এই চক্রে প্রতিমাসে একটি করে ডিম্বাণু পরিহিত হয়ে ডিম্বাশয় থেকে নির্গত হয়ে জরায়ুতে আসে। ইতোমধ্যে জরায়ুতে কিছু হরমোনের প্রভাবে এন্ডোমেট্রিয়াম (জরায়ুর সর্ব ভেতরের স্তর) বৃদ্ধি পায় এবং অনেক নতুন রক্তনালিকা ও গ্রন্থি তৈরি হয় । এই পরিবর্তনটা হয় নিষিক্ত ডিম্বাণুটাকে গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু যদি ডিম্বাণুটা ছত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে নিষিক্ত না হয় তাহলে জয়ায়ুতে ওই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অংশ, রক্তকণিকা, গ্রন্থি, ভেঙে যাওয়া রক্তনালি, মিউকাস এবং অনিষিক্ত ডিম্বাণুটি যোনিপথে বের হয়ে আসে। প্রতিমাসের এই রক্তপাতকেই বলে মাসিক পিরিয়ড বা রজঃস্রাব।  

গড়ে ২৮ দিনের এই চক্রে মিনস্ট্রাল ধাপে রক্ত বের হয়, যা চার থেকে সাত দিন অবধি স্থায়ী হয়। কয়েকটি হরমোনের প্রভাবে এই পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে, তার মধ্যে ফলিকল উদ্দীপক হরমোন, লুটিনাইজিং হরমোন, ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন রয়েছে। এই হরমোনের কোনোটিতে যদি সমস্যা হয় বা প্রজননতন্ত্রে গঠনগত যদি অস্বাভাবিকতা থাকে তাহলে এই চক্র অনিয়মিত হতে পারে। 

গড়ে ২৮ দিনের এই চক্র যদি কখনো অনিয়মিত হয়, যদি অনেক দিন ধরে বন্ধ থাকে, যদি খুব বেশি রক্তপাত হয়, চাকা চাকার মতো রক্ত যায়, সাত দিনের থেকে বেশি দিন ধরে থাকে, যদি অতিরিক্ত ব্যথা হয়, চুলকানি বা সাদা স্রাব যায় তাহলে অবহেলা না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া দরকার। এ ব্যাপারে যেকোনো স্ত্রী ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ আপনাকে সাহায্য করবেন। 

মাসিক চলাকালে পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামের দিকে বা অজ্ঞতার কারণে এখনো অনেক মেয়েই যে কাজটা করে তা হলো পুরনো কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করা অথবা একই কাপড় বারবার ব্যবহার করা, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই সময়ে অবশ্যই স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা উচিত। স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারেরও কিছু নিয়মকানুন আছে। যেকোনো স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড কোনোভাবেই তিন বা চার ঘণ্টার বেশি পরা উচিত নয়। ঋতুস্রাবের শুরুর দুই ও তিন দিন অতিরিক্ত রক্তস্রাব নিঃসরণ হয়। এ সময় অনেকে ছয় বা সাত ঘণ্টা পর পর প্যাড পরিবর্তন করে। কিন্তু চতুর্থ বা পঞ্চম দিন থেকে স্রাব কমে আসায় একই ন্যাপকিন ২৪ ঘণ্টা বা আরো বেশি সময় ধরে অনেকে পরে থাকে, যা তার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই খারাপ। কারণ কী? আমরা জানি ব্যাকটেরিয়ার প্রিয় বাসা হলো উষ্ণ স্থান আর প্রিয় পুষ্টি হলো রক্ত। যদি একটা ন্যাপকিন অনেক বেশি সময় ধরে ব্যবহার করা হয় বা পুরনো অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করা হয় তাহলে তাতে ব্যাকটেরিয়ার কলোনি গড়ে ওঠে। আর ব্যাকটেরিয়া তো এক জায়গায় বসে থাকে না। সে আশপাশের সব জায়গায় আক্রমণ করা শুরু করবে। ফলে মূত্রনালিতে ইনফেকশন, জরায়ুতে ইনফেকশন, ছত্রাকের ইনফেকশন থেকে শুরু করে বন্ধ্যত্ব পর্যন্ত হতে পারে। 

মাসিক বা পিরিয়ড কোনো ‘ট্যাবু’ হওয়া উচিত নয়। এটাও দেখেছি, গার্হস্থ্য বিদ্যা বইটিতে পিরিয়ড সম্পর্কে লেখা অ্যধায়টি অনেকে সযত্নে এড়িয়ে যায়। উচ্চ মাধ্যমিক বইয়ের প্রজনন অধ্যায়টি বলে দেওয়া হয় বাসায় গিয়ে পড়তে। কেন? এ সম্পর্কে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের ধারণা থাকা প্রয়োজন। তাহলে সামাজিক বিষাক্ততায় একটা মেয়েকে টিনএজ বয়সে কারাগারে বন্দি হয়ে থাকতে হবে না। রোগে ভোগা মেয়েটিকে চিকিৎসা না পেয়ে থাকতে হবে না। একটি মেয়েকে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার সময় দেওয়ার জন্য আমাদের পিরিয়ডের ট্যাবু ভাঙতে হবে এ সম্পর্কে জানতে হবে।  

লেখক : শিক্ষানবিশ চিকিৎসক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads