আমাদের জীবনে পানির গুরুত্ব অপরিসীম, বলে শেষ করা যাবে না। মানব শরীরের গড়ে ৫০-৬৫ শতাংশ হলো পানি। শিশুদের শরীরের বেশিভাগই পানি, নবজাতকদের শরীরের ৭৮ শতাংশ পানি। প্রতিদিন মানুষের পানির দরকার হয় পান করা, রান্না করা ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য। পয়ঃনিষ্কাশনের জন্যও পানি অনিবার্য। মানুষের শরীর খাদ্য ছাড়া বাঁচতে পারে বেশ কয়েক সপ্তাহ, কিন্তু পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না কয়েক দিনের বেশি। কাজেই আমাদের বেঁচে থাকার জন্য পানি অপরিহার্য।
ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য কেন, শিল্প-কারখানায়ও পানির ব্যবহার অপরিসীম। মাঝারি আকারের একটি সুইমিং পুল পূর্ণ করতে যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন হয়, তার থেকে বেশি পানি লাগে একটি গাড়ি নির্মাণে। এমন কোনো নির্মাণকাজ নেই যেখানে পানি প্রয়োজন হয় না। পানি খাদ্যও তো বটে। খাদ্য উৎপন্ন করতেও চাই পানি। এক লিটার পানি প্রয়োজন এক ক্যালরি খাদ্যকে সেচের আওতায় আনতে।
তবে প্রয়োজনীয় পানি বিশুদ্ধ হতে হবে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে, সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশনের অভাবে, ভালোভাবে পরিষ্কার পানি দিয়ে হাত না ধোয়ার কারণে ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগে প্রতিবছর পৃথিবীতে মৃত্যু হচ্ছে ৮ লাখ ৪২ হাজার মানুষের, অর্থাৎ প্রতিদিন ২ হাজার ৩০০ জনের। তবে এ সংখ্যা নিকট অতীতে আরো অনেক গুণ বেশি ছিল। জাতীয়-আন্তর্জাতিক সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের নানা উদ্যোগ এ সংখ্যা মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। আমাদের জীবাণুমুক্ত থাকার জন্য এবং জীবাণু ছড়ানো প্রতিরোধের জন্য পরিষ্কার পানিতে হাত ধোয়া অপরিহার্য। কাজেই মানুষ পানি বিশুদ্ধ করার নানা উপায় ইতোমধ্যে রপ্ত করেছে। সবচেয়ে সহজ হলো পানি অন্তত আধা ঘণ্টা ফুটিয়ে পান ও হাত ধোয়ার কাজে ব্যবহার করা।
ডা. ফজলে রাব্বী
সিইও
হেলদি লিভিং ট্রাস্ট
কেউ কেউ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বা ফিটকিরি দিয়ে কিংবা পানি বিশুদ্ধকরণ মেশিন দিয়েও পানি বিশুদ্ধ করছে। পিউরিফায়ারযুক্ত পানির বোতলও পাওয়া যায়। রয়েছে আলট্রাভায়োলেট পিউরিফায়ার। গ্র্যাভিটি ফিড পিউরিফায়ার। ঘরোয়া ও গৃহস্থালি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
তবে সবচেয়ে বহুল প্রচলন হয়েছে বোতলজাত বিশুদ্ধ মিনারেল ওয়াটারের। এই শতকের গোড়ার দিকে বিশ্বব্যাপী এটা বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে। বাংলাদেশও এ থেকে পিছিয়ে নেই। তবে যথাযথভাবে এ প্রক্রিয়া মেনে না চলার জন্য, অর্থাৎ বেশি বাণিজ্যের আশায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পানি সঠিকভাবে বিশুদ্ধ না করে কিংবা কতক ক্ষেত্রে সরাসরি সাপ্লাই পানি বোতলজাত করে বিক্রি করার কারণে হয়তো কিছু মানুষ বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে ভাবনার বিষয় হলো- পানিবাহিত এই রোগগুলো থেকে বাঁচার জন্য আমরা যে প্লাস্টিক বোতলজাত পানি খাচ্ছি তাও আবার ক্ষেত্রবিশেষে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।
সম্পূর্ণ অজ্ঞতাবশত আমরা পানিসুদ্ধ প্লাস্টিকের বোতল গাড়িতে রেখে দিই। কখনো এটি এমনভাবে থাকে যে প্রখর রোদে গরম হয়ে যায় কিংবা বদ্ধ গাড়িতে অনেকক্ষণ থাকার ফলে বোতলসুদ্ধ পানি তাপে গরম হয়ে যায়। তাছাড়া খোলা ভ্যানে পানি ডেলিভারি দেওয়ার সময়ও পলিথিনের মোড়ক, প্লাস্টিক বোতলসহ পানি গরম হয়। প্লাস্টিকের বোতল এভাবে অনেকক্ষণ তাপে থাকলে বোতল থেকে অ্যান্টিমনি (Antimony), বিস্ফেনল এ (Bisphenol A) বা বিপিএ (BPA) নামের কেমিক্যাল দুটি নিঃসরিত হয়, যা আমাদের শরীরকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।
অত্যধিক বিপিএ পুরুষের পুরো হরমোন নিঃসরণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এবং টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণ কমিয়ে দেয়। বিপিএ শরীরে ক্যানসার কোষের জন্ম ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাছাড়া মাত্রাতিরিক্ত এন্টিমনি পেটে ব্যথা, বমি ও বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া ও পেটে আলসার তৈরি করে।
কাজেই পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলোর প্রতি যত্নবান হোন এবং নির্ণয় করুন- পানি আপনার জন্য জীবন হবে, না জীবনসংহারী হবে।