ফারজানা ইয়াসমিন
পাখিদের জন্য পুরো পৃথিবীটাই অবারিত। সর্বত্রই তাদের বাস। তবু কিছু এলাকা কিছু বিশেষ কারণে পাখিদের জন্য দারুণ বাসযোগ্য। দিনাজপুরের ভাটিনা এমনই একটি গ্রাম, যেখানে সারা বছরই পাখিরা দলবেঁধে বাস করে, মনের আনন্দে গান গেয়ে ছুটোছুটি করে বেড়ায়। শুনুন সে গ্রামের কথা-
দিনাজপুরের ভাটিনায় যাওয়ার পথেই গর্ভেশ্বরী নদী। চর পড়ে নদীটি মৃত হলেও এক সময় এর গর্ভ স্পর্শ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। বর্ষায় এর ভাঙাগড়ার খেলা থেকে রেহাই পেতে শহরের চারদিকে তৈরি করা হয় বাঁধ। নদীর তীর ঘেঁষে চওড়া রাস্তা। চারপাশে সারি সারি লিচুগাছ। লোকবসতি বেশ কম। ভাটিনা গ্রামের মেঠোপথটির শুরু এখান থেকেই। গ্রামে ঢোকার আগেই চোখে পড়বে সাইনবোর্ডে লেখা- ‘পাখি সংরক্ষিত এলাকা পাখি মারা নিষেধ’।
ভাটিনার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে বাঁশঝাড়। সারা গ্রামেই রয়েছে বাঁশ আর আমগাছে ঘেরা ছোট ছোট পুকুর। বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেতও আছে চারদিকে। গ্রামের গভীরে যেতে যেতেই কানে ভেসে আসে শত শত পাখির চিৎকার, কোলাহল। প্রতিটি বাঁশবাগানের প্রায় প্রতিটি ডালেই দেখা যাবে নানা জাতের পাখি। অদ্ভুত এক কোলাহল চারপাশে। এ যেন পাখির মহামিলন। দিনের বেলায় চোখের সামনেই দেখা যাবে পানকৌড়িরা পানিতে ডুবে ঠোঁট দিয়ে ধরে আনছে মাছ। বক আকৃতির এক ধরনের বাদামি রঙের পাখি দেখা যাবে বেশ আয়েশি কায়দায় শান্তভাবে ঘুমাচ্ছে। এরা রাতচোরা পাখি। চোরদের মতো দিনে ঘুমায়! দুষ্টুমি করে কেউ যদি একটি শিস বাজিয়ে ওঠে তবে দেখা যাবে হাজারো পাখির মিলিত উড়াল। এ এক অন্যরকম দৃশ্য। ভাটিনা গ্রামের লোকেরা এমন মন জুড়ানো দৃশ্য দেখে প্রতিদিন। শত শত পানকৌড়ি, সাদা বক, কানি বক, গুটকল, রাতচোরা, ঘুঘু, শালিক, টিয়া আর ময়নার ভয়হীন অবাধ আনাগোনা ভাটিনা গ্রামে। ‘আলোর ভুবন’ নামে এক যুব সমবায় সমিতিই এই পাখি রাজ্যের নেপথ্যে।
১৯৯৬ সাল। আর্থিক দৈন্যতায় ভাটিনার লোকেরা ছিল শিক্ষাবিমুখ। আর পরিবেশগত কারণে গোটা গ্রামেই ছিল পাখির আনাগোনা। ফাঁদ পেতে বক ও পাখি ধরাই ছিল গ্রামবাসীর দৈনন্দিন ব্যাপার। গ্রামটিতে বিত্তশালীদের পাখি শিকারের মহড়া চলত সারাদিন।
কলেজ পড়ুয়া একরামুল তখন ভাটিনায় খালার বাড়িতে থাকতেন। তিনিই ভাগ্য গড়া আর গ্রামের জন্য কাজ করার স্বপ্ন ছড়িয়ে দেন যুবকদের মাঝে। তৈরি হয় আলোর ভুবন যুব সমবায় সমিতি। যুবকদের এই উদ্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন স্থানীয় মেম্বার ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হাশেম তালুকদার। অল্প সময়েই ‘আলোর ভুবন’ মানুষের মনে জায়গা করে নেয়। কয়েক মাসের মধ্যেই গোটা গ্রামে পাখির অভয়ারণ্য তৈরির ঘোষণা দেয় সমিতিটি। গ্রামের সবাই মেতে ওঠে পাখিপ্রেমে। ভাটিনায় ঢোকার তিনটি প্রবেশমুখে টানানো হয় ‘পাখি মারা নিষেধ’ লেখা সাইনবোর্ড। ক্রমেই ভাটিনা পরিচিত হয়ে ওঠে পাখিগ্রাম হিসেবে।