রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন আলেয়া আক্তার (ছদ্মনাম)। স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে তার সংসার। স্বামীও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। দুজনের আয়ে পরিবারটিকে অভাবে পড়তে হয় না পারতপক্ষে। কিন্তু সচ্ছল এই সংসারটিতেও হানা দিয়েছে অবিশ্বাস। আর এই অবিশ্বাসের সূত্রপাত আলেয়ার চাকরিকে কেন্দ্র করেই। নিজ প্রতিষ্ঠানে ভালো দক্ষতা দেখালেও সংসার জীবনে ভালো নেই আলেয়া। উঠতে-বসতে শুনতে হয় স্বামীর কটু কথা। প্রতিবাদ করলে শুরু হয় মারধরও।
কর্মজীবনে এমন অসংখ্য প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয় অসংখ্য নারীকে। এমন পরিস্থিতিতে শুধু নারী নয়, মূল্য দিতে হয় তাদের সন্তানদেরও। কলহপূর্ণ পরিবেশ শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দ্বিতীয় খানাভিত্তিক ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের বিবাহিত নারীদের অর্ধেকই কখনো না কখনো স্বামীর হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। উপার্জনকারী নারীদের মধ্যে এ হার বেশি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পারিবারিক নির্যাতন-২০১০ প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্বামীর হাতে শারীরিকভাবে নির্যাতিত ৪২ নারীর মধ্যে মাত্র চারজন মামলা করেছে। ২০০৯ সালে নির্যাতিতদের সংখ্যা ছিল ২২ জন। অর্থাৎ এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছিল। এ ছাড়া যৌতুককে কেন্দ্র করে ৩৮৮ নারী অত্যাচারিত হন, যাদের অধিকাংশ শিক্ষিত ও কর্মজীবী।
বাংলাদেশে পরিচালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি জরিপে দেখা যায়, শহরে বসবাসরত ৪০ শতাংশ কর্মজীবী নারী স্বামীর হাতে নির্যাতিত। কিন্তু এই নির্যাতনের কথা তারা প্রকাশ্যে বলতে পারে না।
শিক্ষক, চিকিৎসক, ব্যাংকার, আইনজীবী, স্থপতি, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন উচ্চপদের নারীরা এখন পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু এমন উচ্চপদে থেকেও স্বামীর নির্যাতনের কথা তারা বাইরের কাউকে পারতপক্ষে জানতে দেন না বলে মন্তব্য করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মহিলা আইনজীবী। এক্ষেত্রে পারিবারিক সম্মান ক্ষুণ্ন হওয়া এবং লোকলজ্জার ভয়ই মূলত কাজ করে।
শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি কর্মজীবী নারীদের ওপর মানসিক নির্যাতনের ভয়াবহতাও কম নয়। বিবাহিত নারীদের নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে নানারকম ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, কটাক্ষ তো আছেই। তার ওপর কর্মজীবী নারীদের বাড়তি পাওয়া হিসেবে উঠতে-বসতে ঘরে সময় দিতে না পারা, রান্না করতে দেরি হওয়া, সন্তানদের অযত্ন হওয়া, শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনদের আপ্যায়ন কম হওয়ার মতো নানা অভিযোগ, অপবাদ আর অপমান সহ্য করতে হয়। তার ওপর নিজের উপার্জিত অর্থ খরচে স্বাধীনতা না-থাকা কিংবা নিজের বাবা-মাকে উপার্জিত অর্থ দেওয়ার স্বাধীনতা না-থাকা কর্মজীবী নারীদের জন্য আরেকটি বড় ধরনের মানসিক নির্যাতন।
দেখা যায়, চাকরিকে কেন্দ্র করে নারীর নির্যাতিত হওয়ার হার গ্রামের চেয়ে শহরেই বেশি। নারীর ক্ষমতায়ন এবং সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় কর্মজীবী নারীর ওপর নির্যাতন উল্টোস্রোতের মতো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনো বহমান।