প্রবাসে চাকরিরত বাবা-মায়ের অতি আদরের কন্যা সীমা (ছদ্মনাম) বলেন, ‘কলেজের একাদশ শ্রেণিতে নেশাগ্রস্ত এক ক্যাডারের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। সে তার অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ফেনসিডিল-মদ খেতো। কৌতূহলবশত আমিও তার সঙ্গে খেতাম। কৌতূহলের মাত্রা নেশায় রূপ নিল। ফেনসিডিলের গণ্ডি পেরিয়ে আমি হেরোইন ও ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়লাম। বাবা-মায়ের লাখ লাখ টাকা আমি নেশার জন্য নষ্ট করে দিয়েছি। প্রবাসী টাকা আমার অ্যাকাউন্টে আসত আর পুরোটা আমি নেশার জন্য খরচ করতাম। ইন্টার পাসের পর আমার নেশাগ্রস্ত প্রেমিককে আমি বিয়ে করলাম, সন্তানও হলো। সন্তান কোলে নিয়েই আমি মাদকের আস্তানায় যেতাম। জানাজানি হওয়ার পর আত্মীয়-স্বজনরা সম্পর্ক ছিন্ন করল। প্রবাস থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ হলো। নেশার জন্য টাকার প্রয়োজনে স্বামী আমাকে দেহব্যবসায় বাধ্য করল। আমার সন্তানটা বড় হতে লাগল। সেও বুঝতে পারল। আমাকে প্রায়ই বলত, মা তুমি ভালো হয়ে যাও, নেশা ছেড়ে দাও, আমি স্কুলে গেলে সবাই আমাকে বলবে তোমার মা নেশা করে। সন্তানের এই ব্যাকুলতা আমার মনে দাগ কেটে দিত। তার ভবিষ্যতের জন্যই আমি নিরাময় কেন্দ্রে এলাম। আজ উনিশ বছর পর নেশার জগৎ থেকে আমি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। সীমার মতো মাদকের অতলে হারিয়ে যাওয়ার গল্প আছে আরো অনেক নারীর।
মাদকের ভয়ানক ছোবলে শুধু পুরুষরা নয়, নারীরাও আসক্ত। মাদকাসক্ত নারীরা পুরুষের সমপর্যায়ের চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
জাতির স্বার্থে সবার উচিত এসব নারীকে পুরুষদের মতোই সাহায্য করা। আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মা, বোন, প্রেমিকা ও স্ত্রী। অথচ আমাদের অনেকেরই ধারণা মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্র শুধু পুরুষদের জন্য, নারীদের জন্য নয়। অনেক নারীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাদের পরিবারের আত্মসম্মানবোধ হয়ে ওঠে পর্বতসমান। লোক জানাজানির ভয়ে আসক্ত নারীটি হয় চার দেয়ালে গৃহবন্দি। প্রিয় পাঠক, আজ আমরা শুনব চারজন নারীর জীবনবার্তা- যারা অকপটে স্বীকার করেছেন তাদের মাদকাসক্তির সূচনা, পারিবারিক বেদনার মারাত্মক পরিণতি।
আরেকটি গল্প শোনা যাক, ১৩ বছর ধরে ফেনসিডিল-গাঁজা, হেরোইনে আসক্ত ছিলেন মিতা (ছদ্মনাম)। মাদকের ভয়াবহ অভিজ্ঞতায় তিনি বলেন, ‘স্বামীর সঙ্গে ক্ষুদ্র মনোমালিন্যে আমি বাবার বাসায় যাচ্ছিলাম। যাওয়ার পথে বাসস্ট্যান্ডে দালালের পাল্লায় পড়লাম। গর্ভস্থ সাত মাসের শিশুসহ আমি বিক্রি হয়ে গেলাম যৌনপল্লীতে। সেটা ছিল মাদকের আখড়া। যৌনপল্লীতে আসা খদ্দেরদের দ্বারা আমি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ি। হেরোইন নিলে প্রথমে বমি হতো, পরে তিন বেলাই নিতে হতো। এভাবে আমি প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে যাচ্ছিলাম। প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে আমি পথেঘাটে পড়ে থাকতাম। নিরাময় কেন্দ্রের কর্মীরা আমাকে রাস্তা থেকে তুলে এনে ভালো করেছে। এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। নেশার জন্য আমার আর খিঁচুনি ওঠে না। "
এই নারীরা মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসারত ছিলেন। বর্তমানে তারা সম্পূর্ণ সুস্থ। নড়বড়ে জীবনে শক্ত অবলম্বনের জন্য তারা সেলাই ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। ভালো হওয়ার জন্য নিজেদের তাগিদ এবং নিরাময় কেন্দ্রের জন্যই তারা ফিরে পেয়েছেন নতুন জীবন। তারা চান তাদের মতো কেউ যেন কষ্টের শিকার না হয়। কৌতূহলেও যেন একবিন্দু মাদক না নেয়। এ দেশে পুরুষদের সঙ্গে আসক্ত নারীর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। অথচ তাদের চিকিৎসার জন্য এখনো পরিবার সমাজ বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এ প্রসঙ্গে মনোচিকিৎসকরা বলেন, মাদকাসক্তি একটি মানসিক রোগ। তাই সঠিকভাবে চিকিৎসা করালে এই রোগ অবশ্যই ভালো হবে। কখনোই আশা ছাড়বেন না। মাদক নিরাময় কেন্দ্র ‘আপন’-এর পরিচালক প্রয়াত ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল বলতেন, ‘মাদকাসক্ত নারীদের প্রতি কখনোই বিরূপ আচরণ করবেন না। তারা পরিস্থিতির শিকার। এমন অনেক ইতিহাস আছে, যারা ৩০ বছর ধরে মাদক নেয়ার পরও ভালো হয়ে গেছেন। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ। মিডিয়া ও পরিবারকে আরো সচেতন হতে হবে। আমরা মাদকাসক্ত নারীদের চিকিৎসা দিই তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপর্যাপ্ত।’
মাদকাসক্ত নারী-পুরুষ কারো প্রতিই অবহেলার দৃষ্টি দেবেন না। আমাদের সমাজে নারীরা তুলনামূলক আরো বঞ্চনার শিকার। তাই মাদকাসক্ত নারীরা হচ্ছে ভয়াবহ পরিণতির পাত্রী। তাদের জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও মানসিক সহযোগিতা। প্রতিটি মাদকাসক্ত নারীর আকাশ থেকে কেটে যাক নেশার মেঘ। মাদকমুক্ত সুস্থ জীবনের আলোয় আলোকিত হোক তার চলার পথ।
ডা. ফারহানা মোবিন
লেখক : মেডিকেল অফিসার, স্কয়ার হসপিটাল, ঢাকা