নতুন স্বপ্ন দেখছে রামনাবাদ নদের শিক্ষিত যুবারা

ছবি : বাংলাদেশের খবর

ফিচার

নতুন স্বপ্ন দেখছে রামনাবাদ নদের শিক্ষিত যুবারা

  • মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)
  • প্রকাশিত ১০ ডিসেম্বর, ২০১৮

শৈশব-কৈশোরে বেড়ে ওঠা প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে হবে আর কিছু দিনের মধ্যেই। প্রিয় স্কুল, খেলার মাঠে আর যাওয়া হবে না মাস্টার্সের ছাত্রী শারমিন সুলতানা শিল্পীর। কাদা মাটির গন্ধ গায়ে নিয়ে বেড়ে ওঠা রামনাবাদ নদের পারের মেয়ে শিল্পীর শেষ গন্তব্য কোথায় এখনো জানা হয়নি। কিন্তু পরিবারের পাশে দাঁড়াতে দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ শিল্পী অতীত স্মৃতিকে ভুলে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে এখনই কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নের ১১নং হাওলা গ্রামের চার সহস্রাধিক পরিবারের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী ও কর্মক্ষম যুবারা। স্বাবলম্বী হতে এখন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে শিক্ষার্থীরা। অথচ কিছু দিন আগেও কেউ নদীতে মাছ ধরত, কেউবা দিনমজুর কিংবা মাঠে চাষ করত। তাদের সবারই লক্ষ্য অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়া এবং শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চারটি ইউনিয়নে প্রায় সাত হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের চার হাজার দুইশ নারী-পুরুষকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এবারই প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবার থেকে একজন সদস্যকে ৩৫টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মক্ষম ও স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিয়েছে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রথম দফায় শিল্পীর মতো ১৩৬ সদস্যকে তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে গত সোমবার (৩ ডিসেম্বর) সনদপত্র বিতরণ করা হয়েছে।

লালুয়া ইউনিয়নের এ শিল্পীর মতো জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত কলেজ ছাত্রী মাসুমা আক্তার, মারুফা, সালমা জাহান, তহমিনা আক্তার, মুক্তা খানম, খাদিজা আক্তার, ছালমা জাহান, নাবিলা তাবাসসুম ও জান্নাতুল ফেরদৌস রিয়া। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে এখন তারা। সফলতার সাথে সম্পন্ন করেছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্স। ভবিষ্যৎ স্বপ্ন নিয়ে তাদের সাথে কথা হয়।

পটুয়াখালী সরকারি কলেজের মাস্টার্সের ছাত্রী শারমিন সুলতানা শিল্পী বলেন, পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে তিন ও ছয় ধারা নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সাত ধারা নোটিশ পেলেই ছাড়তে হবে ছোট থেকে বেড়ে ওঠা প্রিয় বাড়িটি। আর সাঁতার কাটা হবে না বাড়ির পুকুরে। খেলা হবে না স্কুল মাঠে। ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে অবসরে বিকাল বেলা হেঁটে বেড়ানো হবে না। তাদের মতো ১১নং হাওলা গ্রামের সব মানুষের জমি অধিগ্রহণের কারণে ছাড়তে হবে জন্মভূমি।

প্রশিক্ষণ করতে পেরেছেন বলে তিনি খুশি। তিনি আরো বলেন, সরকার জমি নিলেও তাদের পুনর্বাসন করার জন্য যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে তাতে বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে এখানকার শিক্ষিত কিশোরীরা। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ পাওয়ায় এখন চাকরি না পেলেও গ্রামের বাজারে দোকান দিয়ে পরিবার নিয়ে চলতে পারব। নিজে লেখাপড়া শিখেছেন। সরকার প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে ৩০ হাজার টাকাও পেয়েছে সবাই। এখন একটি কম্পিউটার কিনে ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখছি।

শিল্পী বলেন, তার ভাই নিপু তালুকদার ঢাকায় মাস্টার্সের ছাত্র। ছোট বোন সাজেদা সুলতানা এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পিতা আফজাল হোসেন একজন কৃষক। জমি অধিগ্রহণে তাদের চাষের জমি হয়তো থাকবে না। জমির মূল্যও পরিশোধ করবে সরকার। কিন্তু কম্পিউটার প্রশিক্ষণ পাওয়ায় এখন হয়তো আর বেকার থাকতে হবে না।

মাসুমা আক্তার বলেন, এইচএসসি পাশ করার পর ঘরে বন্দি ছিলাম। বড় বোনের বিয়ে হলেও ভাই জহিরুল ইসলাম এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পরিবারের উপার্জন আসে চাষের জমি থেকে। পায়রা বন্দর নির্মাণে তাদের জমি অধিগ্রহণ করা হবে। সরকার জমি অধিগ্রহণের আগেই প্রশিক্ষণ মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ায় এখন খুশি।

একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবার থেকে একজন করে সদস্যকে কম্পিউটার, মোটর ড্রাইভিং ও রাজমিস্ত্রির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ৩ ডিসেম্বর পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর মো. জাহাঙ্গীর আলম এসব প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে সনদপত্র বিতরণ করেন।

পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পায়রা বন্দরে ২০২১ সালের মধ্যে ২২ হাজার কোটি টাকার মধ্যমেয়াদি প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে। তাই জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শিক্ষিত ও কর্মক্ষম নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিকল্প নেই। প্রশিক্ষণ নিয়ে এ শিক্ষিত যুবসমাজ পায়রা বন্দরের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নেবে। তাই প্রথম ধাপে তিন মাস মেয়াদি ১৩৬ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আগামী তিন বছরে ৪২০০ নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। শুধু প্রশিক্ষণই নয়, পুনর্বাসনের জন্য ৩৫০০ পরিবারকে পাকা ঘর বরাদ্দ দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে নির্মাণকাজ শুরু করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, পায়রা বন্দরে ১২টি কম্পোনেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। বিমান বন্দর, বিশেষ অর্থনৈতিক অল প্রতিষ্ঠা, ভাঙ্গা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত ১৮০ কি.মি. রেললাইন, শিপ ইয়ার্ড ও শিপ মেরামত কারখানা তৈরি, ট্যুরিজম সুবিধাদি নির্মাণ, পেট্রোলিয়াম রিফাইনারি প্লান্ট স্থাপন ও এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যসহ স্থানীয় শিক্ষিত ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads