একটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো শিক্ষা। শিক্ষার মান দেশের টেকসই উন্নয়নে মূল ভূমিকা পালন করে। সামনে নতুন বছর। নতুন বছরে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে নতুন সিদ্ধান্ত অপেক্ষা করছে। প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে পরবর্তী স্তরগুলোতেও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত রয়েছে। প্রতিটি পরিকল্পনাই শিক্ষার অবকাঠামো, শিক্ষার মান, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উন্নয়নে। শিক্ষার গুণগত উন্নয়নে এসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের শিক্ষাস্তরের শুরুতেই রয়েছে প্রাথমিক শ্রেণি। শিক্ষাস্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ স্তর। সরকারের দিক থেকে প্রাথমিক শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার প্রচেষ্টার ঘাটতি নেই। এতকিছুর পরেও প্রাথমিক শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। মিড ডে মিলের মতো একটি বৃহৎ উদ্যোগের বাস্তবায়ন এ বছর থেকেই শুরু হয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এ এক বিশাল অর্জন। শিশুদের পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে, উপস্থিতির হার বাড়াতে এবং লেখাপড়ার মনোযোগ ধরে রাখতে এই প্রকল্প অত্যন্ত কার্যকর। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সঙ্গে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শতভাগ ছাত্রছাত্রী উপস্থিতি একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সবকিছু ভালো হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রছাত্রী কিন্ডারগার্টেনের দিকে ঝুঁকছে। ফলে প্রায়ই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে যেসব বিদ্যালয়ে মিড ডে মিলের কার্যক্রম চালু রয়েছে সে বিদ্যালয়গুলোতে যখন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে তখন সব স্কুলের ক্ষেত্রেই একই ফল আসবে। বিশেষ করে নিম্ন-আয়ের মানুষের সন্তান যাদের বাড়িতে পুষ্টিমান নিশ্চিত সম্ভব হয় না, তারাও এর ফলে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে। অভিভাবকরাও আগ্রহী হবে সন্তানকে নিয়মিত বিদ্যালয়ে পাঠাতে। শিক্ষকদের সঙ্গে অভিভাবকের একটু সমন্বয় থাকলেই বিষয়টি আরো সহজ হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে সারা দেশে সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হবে। খাদ্য তালিকায় রান্না করা খাবার, ডিম, কলা ও বিস্কুট থাকবে। তারপরও প্রাথমিক শিক্ষায় অভিভাবকদের আগ্রহ তুলনামূলকভাবে কম পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এই কম আগ্রহের কারণ খুঁজে বের করা দরকার। এর মধ্যেই গড়ে উঠছে কিন্ডারগার্টেন। প্রাথমিক শ্রেণি থেকে শুরু করে সেসব প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক এমনকি কারিগরি স্তরও চালু হচ্ছে। এসব হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন নিয়ন্ত্রণে কোনো নজরদারি নেই। যেখানে যেমন ইচ্ছা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি বহু আইন এসব কিন্ডারগার্টেনে উপেক্ষিত। উপেক্ষিত হওয়ার কারণ তাদের দিকে নজরদারি করার কেউ নেই। বছরের শুরুতেই নানা সুযোগ-সুবিধার কথা বলে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে দেখা যায় এসব প্রতিষ্ঠানকে। এসব কিন্ডারগার্টেনগুলোর মধ্যেই চলে রীতিমতো প্রতিযোগিতা— কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কোন প্রতিষ্ঠান বেশি সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে। অথচ অনেক কিন্ডারগার্টেনের না আছে অনুমোদন আর না আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মতো পর্যাপ্ত অবকাঠামো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন করার পাশাপাশি লেখাপড়ার মান ও ফলাফলও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে অবশ্যই লেখাপড়ার মানের দিকে নজর দিতে হবে। অভিভাবকরা যে প্রতিষ্ঠানে ভালো ফল হয় সেখানে নিজের প্রিয় সন্তানকে ভর্তি করাতে উঠেপড়ে লেগে যায়। রীতিমতো ডোনেশন দিয়ে হলেও ভর্তি করাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। যেখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ করে মফস্বল এলাকার অনেক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর আসন থাকে অনেক ফাঁকা। কেন এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। কারণ ফলাফলে কিন্ডারগার্টেনগুলোই এগিয়ে থাকে। প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে পরীক্ষা নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। পরীক্ষার চাপ কমাতেই এ সিদ্ধান্ত। পরীক্ষা নিয়ে ছাত্রছাত্রীর মাঝে একটি ভীতি কাজ করে। সেই ভীতি তাদের মন থেকে সহজে বের হতে চায় না। পরীক্ষামূলকভাবে ১০০টি বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া হবে না। আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা থাকছে না।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীরা যে একেবারে শৈশব থেকেই প্রচণ্ড চাপে থাকে তা বলাই বাহুল্য। পরীক্ষা আমাদের দেশে রীতিমতো ভীতিকর একটি শব্দ। কারণ পরীক্ষা মানেই সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি লেখাপড়া করা, পরীক্ষা কেন্দ্রের ভাবগম্ভীর পরিবেশে কিছু সময় কাটানো, পাস-ফেলের টেনশন এবং সর্বোপরি মা-বাবা ও আত্নীয়-স্বজনদের ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য। নতুন বছরে নতুন বইয়ের সঙ্গে পোশাক কেনার জন্যও টাকা দেওয়ার কথা। নতুন বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্কুল ড্রেসের জন্য বরাদ্দ সত্যিকার অর্থে একটি চমৎকার বিষয় হবে। তা ছাড়া প্রাথমিকে বৃত্তির পরিমাণও দ্বিগুণ করার প্রস্তাবনা করা হয়েছে। ৮২,৫০০-এর স্থলে এক লাখ ৬৫ হাজার শিক্ষার্থীকে বৃত্তি, ট্যালেন্টপুলে মাসিক ৩০০ টাকার পরিবর্তে ৬০০ টাকা এবং সাধারণ কোটায় ২২৫ টাকার পরিবর্তে ৪৫০ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। বৃত্তিপ্রাপ্তদের সংখ্যা এবং বৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধিও প্রাথমিক শিক্ষাকে আরো এগিয়ে দিতে সাহায্য করবে। গ্রেডিং পদ্ধতি নিয়েও একটি পরিকল্পনা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ কমাতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় গ্রেডিং পদ্ধতি বাতিল করে নম্বরের ভিত্তিতে পাস অথবা ফেল ঘোষণার মাধ্যমে মেধার যাচাই করার পরিকল্পনা করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন গ্রেড নিয়ে আজ শিশুদের মনের ওপর যে চাপ পরে তা থেকে বের হতে শিশুদের অনেক সময় লেগে যায়। সামাজিকভাবেও তাকে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি অনেকটা দীর্ঘ বলে মনে হয়। এই সময়সূচি পরিবর্তনের দাবি রয়েছে শিক্ষকদের। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি। অপরদিকে দেশের কিন্ডারগার্টেনের সময়সূচি সকালে। দুপুর বারোটার আগেই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি ফেরে। এসব ছাত্রছাত্রী যখন খেলাধুলা করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্কুল শুরু করে। সময়টা নিয়ে দেশের শিক্ষাবিদরা একটু গবেষণা করতে পারেন। একটু কমানো বা সময়সূচিকে নতুন করে করা যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে চলতি বছর আলোচনা হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে ৪টি স্কুলে নতুন সময়সূচির খবরও পেয়েছিলাম। শিক্ষকদের বেতন গ্রেড সমন্বয় নিয়ে চলতি বছর আলোচনা হয়েছে। প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড সমন্বয়, প্রধান শিক্ষকদের বেতন দশম গ্রেডে প্রদানসহ কয়েকটি বিষয় এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। কর্তৃপক্ষও বিষয়টি নিয়ে আন্তরিক। আশা করি নতুন বছরেই এর সুষ্ঠু সমাধান হবে। একজন সহকারী শিক্ষক হিসেবে যখন কেউ যোগদান করেন তখন তাদের ভেতর পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষক বা সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে বা তার থেকেও বড় পদে চাকরির আশা তিনি করতে পারেন। কারণ অন্য সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ যতটা রয়েছে এখানে ততটা নেই। সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকে উন্নীত হলেও সেই প্রক্রিয়াও খুব দীর্ঘ।
প্রাথমিক শিক্ষাস্তর সকল শিক্ষাস্তরের ভিত্তি। সরকার এই স্তরকে শক্তিশালী করতে সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ওপর আস্থা এবং কিন্ডারগার্টেননির্ভর শিক্ষার প্রভাব কমাতে শিক্ষকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিযোগিতা মূলত আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেনের সঙ্গে। এই তীব্র প্রতিযোগিতায় প্রাথমিক শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি গুণগত মান উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। সরকার আন্তরিক আর সেইসঙ্গে তাদের আন্তরিক হতে হবে, যারা এই শিক্ষাদানের সঙ্গে জড়িত এবং সেটা তাদের নিজেদের প্রমাণ করতে হবে। একই সঙ্গে এই গুরুত্বপূর্ণ স্তরে যারা কাজ করেন, তাদের ভালো-মন্দ, পূর্ণতা-অপূর্ণতাও কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় নিতে হবে। মোট কথা নতুন বছরে প্রাথমিক শিক্ষা এগিয়ে যাক নতুনভাবে, এই প্রত্যাশা করি।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
sopnil.roy@gmail.com