মুহাম্মাদ আবু আখতার
বিপদ-আপদে পড়ে অনেকে আল্লাহতায়ালার প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। কিন্তু এটা মোটেও উচিত নয়। আল্লাহতায়ালা যাকে যত বেশি ভালোবাসেন তাকে তত বেশি বালা-মুসিবত দিয়ে পরীক্ষা করেন। এজন্য নবী-রাসুলদের জীবনী পড়লে আমরা দেখতে পাই তারা সাধারণ মুসলমানদের চেয়ে অনেক বেশি দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হয়েছিলেন। এজন্য আল্লাহতায়ালার প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র কোনো অভিযোগ ছিল না। শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তারা একনিষ্ঠভাবে দীন প্রচারের কাজ করে গেছেন। বিপদ-আপদে যারা আল্লাহতায়ালার ওপর রাজি-খুশি থাকে তিনি তাদের ওপর সন্তুষ্ট হন এবং তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। পক্ষান্তরে বিপদ-আপদে পড়ে যারা আল্লাহতায়ালার ওপর অসন্তুষ্ট হন তিনিও তাদের ওপর অসন্তুষ্ট হন। সাধারণত গোনাহগারদের ওপর দুনিয়াতে কোনো শাস্তি নাজিল হয় না। তখন অনেকে ধোঁকায় পড়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব বিষয়ের রহস্য সুস্পষ্ট ভাষায় হাদিসে বর্ণনা করেছেন। হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা যখন তার কোনো বান্দার কল্যাণের ইচ্ছা করেন তখন দুনিয়াতেই তাকে তাড়াতাড়ি শাস্তি দেন। পক্ষান্তরে তিনি যখন তার কোনো বান্দার অকল্যাণ্যের ইচ্ছা করেন তখন তার গোনাহ হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়াতে শাস্তি দেন না। অবশেষে কিয়ামতের দিন তাকে পরিপূর্ণ শাস্তি প্রদান করবেন।’ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, ‘অধিক পুরস্কার অধিক কষ্টের ফল। আল্লাহতায়ালা যখন কোনো কওমকে ভালোবাসেন তখন তাদেরকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেন। যে ব্যক্তি এ পরীক্ষায় সন্তুষ্ট থাকে তার জন্য রয়েছে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর যে ব্যক্তি অসন্তুষ্ট হয় তার জন্য রয়েছে মহান আল্লাহর অসন্তুষ্টি।’ (মুসলিম, হাদিস নং-২৩৯৬, ইবনে মাজাহ, হাদিস নং- ৪০৩১)
আল্লাহতায়ালা মানুষকে বিভিন্ন বিপদ-আপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। যারা ধৈর্য ধারণ করে তারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। তাদের জন্য আল্লাহতায়ালার পক্ষ হতে সুসংবাদ রয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে ভয় ও ক্ষুধা দিয়ে এবং তোমাদের জান, মাল ও ফসলের ক্ষতি সাধন করে পরীক্ষা করব। আর আপনি ধৈর্যশীলদেরকে সুসংবাদ দান করুন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৫৫)
মুমিন ব্যক্তি যে কোনো দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ করলে এর বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা তার গোনাহ মাফ করে দেন। হজরত আবু সাঈদ ও হজরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, "কোন মুসলমানের যে কোনো ক্লান্তি, রোগ-ব্যাধি, দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা, দুঃখ-কষ্ট ও অস্থিরতা হোক না কেন, এমনকী কোনো কাঁটা ফুটলেও এর কারণে মহান আল্লাহ তার পাপসমূহ মাফ করে দেন। (বুখারি, হাদিস নং-৫৬৪২, মুসলিম, হাদিস নং- ২৫৭৩) সুহাইব ইবনে সিনান (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,‘মোমিন বান্দার ব্যাপারটি আশ্চর্যজনক। তার সব কাজই কল্যাণময়। তার আনন্দজনক কিছু হলে সে আল্লাহতায়ালার শোকর আদায় করে, তাতে তার কল্যাণ সাধিত হয়। আর তার দুঃখজনক কিছু হলে সে ধৈর্যধারণ করে, এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়।’ (মুসলিম, হাদিস নং-২৯৯৯, আহমদ, হাদিস নং- ১৯৪৬০)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর বৈশিষ্ট্য ছিল তারা কোনো বিপদ-আপদে কখনো ধৈর্যহারা হতেন না, বরং ধৈর্যধারণ করে এবং নামাজ পড়ে আল্লাহতায়ালার কাছে সাহায্য কামনা করতেন। তারা সর্বদা আল্লাহতায়ালার এ হুকুম মেনে চলতেন- "তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা ধৈর্যশীলদের সাথেই রয়েছেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত নং- ১৫৩)
শুধুমাত্র বিপদ-আপদেই যে ধৈর্যধারণের প্রয়োজন তা নয়, বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যেসব কাজ করতে আদেশ করেছেন সেগুলো পালন করা এবং যেসব কাজ হতে নিষেধ করেছেন সেগুলো হতে বিরত থাকতেও ধৈর্যের প্রয়োজন। কেননা, এতে অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। যা ধৈর্যশীলদের পক্ষেই সম্ভব। দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়, রমজানে একমাস রোজা রাখা, ধনীদের জন্য বছরে একবার যাকাত দেওয়া ও জীবনে একবার হজ পালন করা, আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা, পর্দা করা, ন্যায়ের পথে চলা ইত্যাদি আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য যে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তার জন্য ধৈর্য আবশ্যক। এছাড়া সুদ-ঘুষ, মদ-জুয়া, চুরি-ডাকাতি, ব্যভিচার-ধর্ষণ, অন্যায়-অবিচার, শোষণ-দুর্নীতি, ছিনতাই-রাহাজানি ইত্যাদি জঘন্য পাপকাজ থেকে বাঁচার জন্যও ধৈর্য আবশ্যক। এজন্য ওলামায়ে কিরাম ধৈর্যকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। এক. বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ। দুই. আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্যধারণ। তিন. গোনাহর কাজ হতে ধৈর্যধারণ।
ধৈর্যশীলদের জন্য আল্লাহতায়ালা অগণিত পুরস্কারের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, নিশ্চয় ধৈর্যশীলদেরকে অগণিত পুরস্কার পরিপূর্ণভাবে দেওয়া হবে। (সুরা যুমার, আয়াত-১০)। যারা ধৈর্যের সাথে আল্লাহতায়ালার হুকুম-আহকাম সঠিকভাবে মেনে চলে, এর প্রতিদানে আল্লাহতায়ালা জান্নাতে তাদেরকে বাসগৃহ দান করবেন এবং তারা সেখানে মহাসম্মানের সাথে চিরকাল বসবাস করবে। আল্লাহতায়ালা বলেন,‘তাদের ধৈর্যের প্রতিদানে তাদেরকে জান্নাতে বাসগৃহ দেওয়া হবে এবং সেখানে তাদেরকে সালাম ও অভিবাদন জানানো হবে। সেখানে তার চিরকাল থাকবে| অবস্থানস্থল ও বাসস্থান হিসেবে তা কতোই না উত্তম!’ (সুরা ফুরকান, আয়াত-৭৫, ৭৬)
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক