ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার জাগরণে ধর্মীয় বিভাজন দূর করার প্রত্যয় নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন সামাজিক সংগঠন ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’। সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে গতকাল আয়োজিত অনুষ্ঠানে গুণিজনরা অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। স্বপ্নের দেশ গড়তে ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই বলেও অনুষ্ঠানে মত দেন শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় নেতারা।
গতকাল সকালে ঢাকার জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে নানা শ্রেণি ও পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা হয়। বেশ কিছু দিনের কাজের ধারাবাহিকতায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিসহ সমাজের নানা পেশার শীর্ষস্থানীয়দের এক মঞ্চে আনে নতুন এ সংগঠন। অনুষ্ঠানে তরুণ প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান ছিল বক্তাদের কণ্ঠে। মত ও পথের ভিন্নতার মাঝেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে সমন্বয়ের ধারায় এমন প্রত্যয়ের কথা বলেছেন বক্তারা। ধর্ম যেন রাজনীতির হাতিয়ার হতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখার আহ্বানও জানান তারা।
‘গাহি সাম্যের গান’ স্লোগান নিয়ে আসা এ নাগরিক ফোরামের উদ্দেশ্য তুলে ধরেন এর আহ্বায়ক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের যেই প্রধান চেতনা ধর্মনিরপেক্ষতা, সেটার দিকে আমরা ফিরে যেতে চাই। তাহলে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ, শোষণহীন বাংলাদেশ ও সাম্যের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের আঘাত আসতে পারে, আমরা আগে থেকে প্রস্তুত থাকতে চাই। আমরা জানি, এই দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও সাম্যের পক্ষে। আমাদের এখন ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আপনাদের সঙ্গে পেলে আমরা জয়ী হব।’
শুরুতে কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে পরিচালিত হলেও পরবর্তীতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের কাজ করা হবে বলে জানান পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা সেটির মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক আমরা তৈরি করতে চাই। আজকে আত্মপ্রকাশ হলো। এরপর ডিসেম্বর পর্যন্ত সুধী সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি আমরা হাতে নেব।’ এ ছাড়া সাম্প্রদায়িক শক্তির কোনো আঘাত এলে সেটি প্রতিহত করতে নতুন এই সংগঠন প্রস্তুত থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে জাতীয় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী, ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী, সাংবাদিক আবেদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি মাহফুজা খানম, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মো. আফজাল, বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা শুদ্ধানন্দ মহাথেরো, রামকৃষ্ণ মিশনের সাধারণ সম্পাদক স্বামী গুরু সেবানন্দ, খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও, ইসকনের প্রতিনিধি সুখীল দাস ও সংগঠনের সদস্য সচিব মামুন আল মাহতাব বক্তব্য দেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রচারিত এক ভিডিও বার্তায় জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে হাজার হাজার বছর ধরে নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ সম্প্রীতি নিয়ে বসবাস করছে। দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে গেছে। বিভেদ এবং সংঘাত যে হয়নি তা নয়। সব মিলিয়ে যে সম্প্রীতির অবনতি হয়েছে, তা সত্ত্বেও আমরা এর উপরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছি।’ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ধর্মনিরপেক্ষতাকে ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং বাহাত্তরের সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
আনিসুজ্জামান বলেন, ‘১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সামনে আনা হয়েছে। তার ফলে আমরা দেখি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শ ও বাহাত্তরের সংবিধানের যে আদর্শ সেটা সাময়িকভাবে হলেও ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। তারপর মানুষ আবার এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে ফিরিয়ে এনেছে।’
‘আমরা সেজন্য সবার কাছে আহ্বান জানাই, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেটা আমরা ইতিহাস থেকে পেয়েছি, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকে পেয়েছি, যা আমাদের সংবিধান থেকে পেয়েছি, তা যেন ঊর্ধ্বে তুলে ধরে সামনের দিকে অগ্রসর হই।’
জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে সূচনা হওয়া অনুষ্ঠানে অতিথিদের পাশাপাশি শিক্ষার্থী, ধর্মীয় সংগঠনের কর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীদের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ ছিল জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তন।