বিজ্ঞানের দর্শনে পার্থিব জগতের নানা বিষয় নিয়ে গড়ে উঠেছে বিজ্ঞানজগৎ। আর বিজ্ঞানের এ জগৎ ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে পৌঁছে দিয়েছে আধুনিক সভ্য ইতিহাসের মণিকোঠায়। বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। আধুনিক এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য ও সত্য উদঘাটিত হচ্ছে। সময়ের বিবর্তনে রাজনীতি, অর্থনীতি, জলবায়ুর পরিবর্তনসহ নানা কারণে দ্রুত বদলে যাচ্ছে বিশ্ব প্রেক্ষাপট। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির অনেক উন্নতি ঘটেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশেও লেগেছে প্রযুক্তি নামের জাদুর কাঠির ছোঁয়া। ‘দিন বদল’ মানে এদেশের মানুষের জীবন মানের পরিবর্তন। এর বাস্তবায়নের জন্য প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন করতে হবে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে সততার সাথে। সময়কে কাজে লাগাতে হবে তাহলেই জীবন মানের পরিবর্তন ঘটবে। এ লক্ষ্য নিয়েই দিন বদলের পালায় এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
দিন বদলের পালায় বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে কয়েকটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, বৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থা, কারিগরি শিক্ষার প্রসার, কৃষির উন্নতি, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাম্য-মৈত্রী ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, গণতন্ত্রের সফলচর্চা, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের পুনরুজ্জীবন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে। বর্তমান বিশ্বের উন্নয়নের সিংহভাগ আধুনিক প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। সারা দেশকে প্রশাসনিক দিক থেকে সহজ করার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার অনস্বীকার্য। প্রতিটি উপজেলায় সার্ভার স্টেশন স্থাপনের দিন বদলের পালায় বাংলাদেশকে গতিশীল করা সম্ভব। বাংলাদেশের অবস্থার পরিবর্তন আনতে হলে প্রথমেই জোর দিতে হবে সর্বক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে। অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি, ব্যবসা, বাণিজ্য, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সংযোগ ও সিসি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে দিন বদলের পালায় বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। শিক্ষার উন্নতি ছাড়া জাতির উন্নতি আশা করা যায় না। দীর্ঘদিন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মান্ধাতা আমলের পদ্ধতিতে চলছিল বলে শিক্ষাক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধিত হয়নি। সাম্প্রতিককালে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুলে দিয়েছে সৃৃৃৃজনশীল প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি। এ পদ্ধতির সাথে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা। যার ফলে ঘরে বসেও অনলাইনের মাধ্যমে বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। দিন বদলের পালায় কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এদেশের যুবসমাজ শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত হলে নিজেরাই কর্মসংস্থান তৈরি করে নিতে পারবে। এক্ষেত্রে স্বল্প পুুঁজি নিয়েও কাজ করা সম্ভব। কারো অর্থনৈতিক সংকটে সরকার সহজ শর্তে ক্ষুদ্রঋণ সহায়তার মাধ্যমে ব্যক্তিকে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে বেকার সমস্যাও অনেকাংশে লাঘব হতে পারে। বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ হওয়ায় এদেশের সিংহভাগ মানুষ কৃষির সাথে জড়িত। কিন্তু এদেশের কৃষকরা নিরক্ষর হওয়ায় কৃষিক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির প্রয়োগ করতে না পারায় সনাতন পদ্ধতিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ফলে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। কৃষিব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি ঘটাতে না পারলে বাংলাদেশকে দিন বদলের পালায় এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। মানুষ কাজ করে খাদ্য সংস্থানের জন্য। তাই দিন বদলের পালার প্রধান লক্ষ্য হতে হবে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জন। এক্ষেত্রে ভর্তুকি দিতে হলেও দিন বদলের পালার স্বার্থে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আধুনিক বিশ্বের প্রায় সকল কর্মকাণ্ডই বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। কৃষি, শিক্ষা, প্রযুক্তি, কলকারখানা, অফিস ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে বিদ্যুতের ব্যবহার অনস্বীকার্য। বিদ্যুৎ ছাড়া উৎপাদনের কথা চিন্তা করা যায় না। আর উৎপাদন ছাড়া মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। এই অসম্ভব ব্যাপারটিই সম্ভব হয়ে উঠেছে বিদ্যুতের ব্যবহার দিয়ে। সর্বশেষ ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে মার্চ ২০১৮ পর্যন্ত দেশে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৮৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তাই একথা মনে রাখতে হবে যে, একটি পরিপূর্ণ তথ্যপ্রযুক্তির কাঠামো গড়ে ওঠার জন্য যথাযথ বিদ্যুতের ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন। তাই বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে আরো বেশি সক্রিয় হতে হবে। যোগাযোগব্যবস্থা গতিশীল ও নিরাপদ না হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম সড়ক ও নৌপথে দুর্ঘটনাজনিত সমস্যা অনেক বেশি। সড়কপথে চলাচল যেমন নিরাপদ নয়, তেমনি নৌপথেও। বাংলাদেশের দিন বদলের পালায় এটি একটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা। দেশের মানুষের চলাচল নিরাপদ করে দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে হলে এ সমস্যার প্রতিকার প্রয়োজন। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে নানা জাতিধর্মের বসবাস। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই পাশাপাশি বসবাস করে। সকলেই বাঙালি এবং পরস্পর মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ। সাম্যবোধ ও মৈত্রীর বন্ধন থাকলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ফাটল ধরার সম্ভাবনা থাকে না। ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় শান্তিময় পরিবেশ। এই বোধ দিন বদলের পালায় বাংলাদেশকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্র পরিচালনার সবচেয়ে উন্নত মাধ্যম হলো— গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। ইংল্যান্ড, জাপান প্রভৃতি দেশে রাজতন্ত্র থাকার পরও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র চলে। পরিতাপের বিষয় আমাদের দেশে গণতন্ত্র থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের সফল চর্চা নেই। দিন বদলের পালায় মানুষের মধ্যে যথার্থ গণতান্ত্রিক বোধ জাগিয়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশের অগ্রগতি সাধিত হবে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের কুটিরশিল্পের তৈরি পণ্যদ্রব্যের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। বর্তমানেও আন্তর্জাতিক বাজারে এর বিপুল চাহিদা রয়েছে। কিন্তু নানা কারণে এদেশের কুটিরশিল্পের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা অনেকেই এ খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। কাজেই দিন বদলের পালায় কুটিরশিল্পের পুনরুজ্জীবন ও মানোন্নয়নের জন্য সরকারি উদ্যোগ জোরদার হওয়া দরকার। কুটিরশিল্পের উন্নয়ন ঘটলে এ খাত থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতে পারে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল জনবহুল রাষ্ট্র। এখানে কর্মসংস্থানের চেয়ে জনসংখ্যা অনেক বেশি। জনসংখ্যার তুলনায় কর্মক্ষেত্র না থাকায় দিন দিন বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাজের সন্ধানে ঘুরছে অনেক শিক্ষিত বেকার। তাই দিন বদলের পালায় বাংলাদেশের অগ্রগতি ও স্বনির্ভরতার জন্য জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। এক্ষেত্রে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে- কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে যুবকদের উৎসাহ ও সহায়তা দান এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে বেকারদের বিভিন্ন দেশে পাঠানো।
বর্তমান পৃথিবী তথ্যপ্রযুক্তির পৃথিবী। পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে। বর্তমান বিশ্বে যে জাতি যত বেশি প্রযুক্তিতে দক্ষ, সে জাতির সার্বিক অবস্থাও তত বেশি উন্নত। নানারকম প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে দিন বদলের পালায় এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে সকলকে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে সতর্ক ও যত্নশীল হতে হবে। তবেই দিন বদলের পালায় বাংলাদেশ সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
লেখক :তৌহিদা আকতার
রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়