তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ ও পরিমিতিবোধ

প্রতীকী ছবি

মুক্তমত

তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ ও পরিমিতিবোধ

  • প্রকাশিত ১৩ এপ্রিল, ২০২১

প্রতিটি প্রজন্মের একটি আলাদা প্যাটার্ন থাকে, থাকে তাল মিলিয়ে ছন্দোবদ্ধভাবে চলার একটা শক্তি। সবসময় উজানের বিপরীতে হাঁটাও তাই ঠিক নয়। একটা সময় অন্তত ২০২১ সালের আগপর্যন্ত আমি ব্যক্তিকভাবে  ভাবতাম নিজেকে সবার সামনে উপস্থাপনই শেষ কথা নয়। যদি সত্যিই কেউ জ্ঞানী হোন, প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারেন, তবে একসময় না একসময় তার আলো বিকরিত হবেই। কিন্তু সময়ের সাথে দর্শনও ভিন্নরূপ নেয় এবং পরিবর্তনই জীবনের একমাত্র সারসত্য। বর্তমান সময়টা ঢাকির এবং ঢাকি মানেই যে নিম্নমানের এ ধারণা সর্বাংশে সত্যও নয়। আশপাশের প্রজ্ঞাহীন মানুষেরাও নিজেকে এত ফলাওভাবে উপস্থাপন করেন যে, প্রজ্ঞাবানও যদি এ পন্থায় না নামেন একটা সময় প্রজ্ঞাবানদেরও এ দায় নিতে হবে। কারণ, প্রজ্ঞাবানেরা যখন সামনে আসবেন না, অন্তরালে থাকবেন তখন সাধারণ মানুষ এই ভুল ঢাকঢোলেই আচ্ছন্ন হবেন এবং প্রজ্ঞার সাথে পরিচিতই হবেন না। কারণ তাদের সামনে অল্টারনেটিভ কোনো পন্থা নেই। যদি অল্টারনেটিভ পন্থা থাকত তবে অবশ্যই সাধারণ মানুষ আলাদা আলাদা পন্থা ভেবে তুলনামূলক পর্যালোচনা করে একটি গ্রহণ করত। তার মানে মেধাবী, প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা যতই অন্তরালে চলে যাবেন, ততই সস্তা মানুষের উত্থান হবে। পরোক্ষভাবে তার মানে প্রজ্ঞাবানেরা সামনে না এলে দেশ ও জাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সাধারণ মানুষের এত সময় এবং ধৈর্য কোনোটাই নেই যে তারা সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করবেন। তারা কাজের ফাঁকে বিনোদনের জন্য অ্যান্ড্রয়েড ঘাটার সময় নিউজ ফিডে যা স্ক্রল করে পায়, তা-ই তাদের জ্ঞান, তা-ই তাদের অর্জন। তারা কখনো গুগল করে বা ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ নেন না যে, যাকে তিনি ফলো করছেন আসলেই তিনি কতটা বৈদগ্ধ্যপূর্ণ বা তিনি কী জন্য কী উদ্দেশ্যে এসব ফলাও করেন, প্রচার করেন। ফলে তারা যা দেখে তা-ই বিশ্বাস করে। এর ফল কি আমরা দেখিনি! বাজার ভরে গেছে সস্তা সাহিত্যে বা একেবারে মানহীন প্রকাশনায় এবং দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের তরুণ প্রজন্ম বড় হচ্ছে এমন একটা সস্তা প্রচারণার প্রকাশনার যুগেই। আবার একেবারে সাহিত্য থেকে সরে এসে সমাজের দিকে চোখ দিলেও দেখবেন কত পরিবর্তন এসেছে শেষ কয়েক দশকে। প্রচার প্রসারের জগতে যখন পৃথিবী একটা অন্য জায়গায় পৌঁছে গেছে, তখনো আমাদের প্রজ্ঞাবানেরা এই ঢেউকে আত্তীকরণ করে নেননি। তারা তাদেরকে একটা জায়গায় সীমাবদ্ধ করে ফেলেছেন। এই ফাঁকে সেখানে ঢুকে গেছে আরেকদল। ফলে সাধারণ মানুষ যদি প্রতিনিয়ত যুক্তিহীন ধর্মান্ধ বিষয়াবলি দেখেন, শোনেন, তিনি সেটিই বিশ্বাস করতে শুরু করবেন। এখন একজন প্রজ্ঞাবান যদি এই বলে অন্তরালে থাকেন যে, আমি ‘প্রচারেই প্রসার’ এই সস্তা দর্শনে নিজেকে জাহির করব না, তাহলে আসলে তার এই সস্তা সুপার ইগোর জন্যই দেশ ও জাতি একসময় ভুক্তভোগী হবে। প্রজ্ঞাবান ও মেধাবীরা (অভিমান বা ইগো যেটার কারণেই হোক) দূরে সরে যান বলেই প্রকৃতি যেহেতু শূন্যস্থান চায় না, তাই অযোগ্য ব্যক্তি দিয়েই সে স্থান পূরণ হয়। ফলত এই মেধাহীন ব্যক্তিরাই আত্মপ্রচারে আত্মপ্রসারে পরবর্তী অন্তঃসারশূন্য প্রজন্ম তৈরি করে। তাহলে পরোক্ষভাবে এই মেধাহীন বা আত্মপ্রচারকদের সামনে আনছেন বা আনার সুযোগ করে দিচ্ছেন কারা? প্রজ্ঞাবান এবং তাদের ইগোই তো। 

প্রতিটি প্রজন্মের জন্য নিয়ম আলাদা। জেনারেশন গ্যাপ বলে একটা কথা সবসময় থাকে। আমি বিশ্বাস করি তারাই প্রকৃতপক্ষে প্রজ্ঞাবান, যারা সময়ের এই ঢেউকে প্রতিহত করে নিজেকে তার সাথে মানিয়ে নেন এবং নতুন উল্লাসে যাত্রা করেন। সময়টা এখন ডিজিটাল ওয়েবের বা প্রচারের, প্রসারের। সব সময় প্রচার, প্রসার খারাপও নয়। তবে হ্যাঁ, একথা অনস্বীকার্য যেকোনো কিছুরই অতিরিক্ত বা অতিরঞ্জন কাম্য নয়। একটা নির্দিষ্ট সীমায় থেকে, অন্যের বিরক্তির উদ্রেক না করে আপনি আপনার ভালো কাজগুলো যতটুকু প্রচার করতে পারেন এবং তার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন তা অবশ্যই কাম্য। যেমন ধরুন, আপনি বৃক্ষরোপণ, পাঠাগার তৈরি, সংখ্যালঘু বা অনগ্রসর মানুষের জন্য কিছু করলেন এবং তা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করলেন, এটির অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক আছে। তাতে করে আরো অনেকে বা নতুন প্রজন্মের মনে এই বোধ জাগ্রত হবে যে এটি একটি ভালো কাজ, এটা করা উচিত। কিন্তু কোনোকিছুর অতিপ্রদর্শন এবং কতটুকু প্রদর্শিত হওয়া উচিত, সে পরিমিতিবোধ যদি আপনার না থাকে তাহলে অবশ্যই তা ক্ষতিকর। আর এই পরিমিতিবোধ যদি আপনার না থাকে, তবে আপনি কিসের প্রজ্ঞাবান! উদাহরণ হিসেবে উপর্যুক্ত বিষয়টিকেই আলোকপাত করা যেতে পারে। আপনি যদি একজন অনগ্রসর ব্যক্তিকে সাহায্য করেন এবং তাঁর ছবি পোস্ট করেন বা তার অনুমতি ছাড়াই ডিজিটাল প্রকাশমাধ্যমে প্রকাশ করেন তা অবশ্যই নেতিবাচক। কাউকে সাহায্য করা অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু তখন পর্যন্ত যতক্ষণ তার পরিমিতিবোধ থাকে। আমরা দেখেছি একটি কম্বলদানের জন্য এক জোড়া হাতের বিপরীতে কতশত জোড়া হাত ছবিতে প্রদর্শিত হয়েছে! আমরা এটিও দেখেছি নিউজ চ্যানেল বা ক্যামেরা কাভারেজ আসেনি বলে ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার সামনে নিয়ে চার ঘণ্টা বসে থাকতে, কখন আসবে ক্যামেরা, তারপর দান করার প্রমাণপত্র, তারপর না খাওয়া মানুষগুলোর আর্তনাদ! আরো একটা জোরালো প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে। প্রজ্ঞাবানেরা বা উদারপন্থীদের এই প্রচারে না আসার কারণেই কিন্তু একদল প্রতিক্রিয়াশীল সে জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। ফলে যেখানে আজ থেকে এক যুগ আগেই সুন্দর দেশাত্মবোধক গান, ভালো ভালো অনুপ্রেরণামূলক বিষয়াবলি, জ্ঞানের কথা সামনে আসত, সেখানে এখন সামনে আসে ভণ্ড হুজুরের মনগড়া ওয়াজ, ব্যক্তিস্বার্থে জড়িত সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা। যে দেশটিতে আগে সুমন আর সোমেন একসাথে বন্ধুর মতো হাঁটত, প্রকৃতি দেখত সেদেশে তারা এখন বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও ফেসবুকে কমেন্টে ঝগড়াঝাটি, একে-অপরকে হুমকি-ধমকি দেয়। তারা যেন ভুলেই গেছে কখনো তারা একসাথে কোনো পুজোয় মুড়ি-মুড়কি খেয়েছে, কাকীর হাতের বানানো নারিকেলের নাড়ু খাওয়ার লোভে অপেক্ষা করেছে দেবীর ধরিত্রীতে আসার; তারা ভুলেই গেছে কোনো এক কোরবানির ঈদে তারা একসাথে ছাগলের সিনার মাংসের জন্য উদগ্রীব হয়েছে কতক্ষণে রান্না হবে, প্রতীক্ষা করেছে শবেবরাতের রুটি হালুয়ার! তারা যেন কখনো একসাথে কোথাও ছিল না। এই যে এই ভূখণ্ডের একপ্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিগুলো হরণ হয়ে গেল, এ দায় কার? প্রজ্ঞাবানদের-ই তো!

এককথায় প্রজ্ঞাবানদের সামনে আসা উচিত। ডিজিটাল মিডিয়া বা প্রচার, প্রসার সবসময় নেতিবাচক নয়, সস্তা নয়। এই ধারণা থেকে প্রজ্ঞাবানেরা যতদিন না বের হতে পারবেন, ততদিন এসব সস্তা, অগভীর জলের মানুষেরা প্রচারের গুণে সামনে আসবেন এবং নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে থাকবেন। আমি শতভাগ আশাবাদী মানুষ। আমি স্বপ্ন দেখি আমাদের নতুন প্রজন্মের কথা ভেবে হলেও নন্দলালদের মতো গা-ঢাকা না দিয়ে প্রজ্ঞাবানেরা সামনে আসতে শুরু করবেন। সময় সবসময় একটা সুযোগ রাখে। বর্তমান সময় থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। সময় হাতে খুব কম, জল এখনো ততদূর গড়ায়নি, এটাই আমি বিশ্বাস করতে চাই। বিশ্বাস করতে চাই মানুষের জয় হোক এবং তা তখনই একমাত্র সম্ভব যখন প্রজ্ঞাবানেরা নীরব থাকবেন না। আর কতদিন শীতনিদ্রায় থাকবেন? প্রতিবাদ না করুন, কথা বলুন... স্বাধীনতার ৫০ বছর হলো, আর কত অপেক্ষা করতে হবে, পাঞ্জেরি? বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আমি বিশ্বাস করতে চাই, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে চাই এখনো জল অতদূর গড়ায়নি আর প্রজ্ঞাবানেরা ততদূর গড়াতেও দেবেন না।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads