ফিচার

স্টামফোর্ড মাদকবিরোধী ফোরাম

তারুণ্যনির্ভর মাদকমুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যয়

  • অরণ্য সৌরভ
  • প্রকাশিত ২১ জুন, ২০২১

দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যার একটি মাদক। বন্ধুদের প্ররোচনায়, কৌতূহলবশত কিংবা ব্যক্তিগত হতাশার কারণে অনেক তরুণই মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। অন্যদিকে মাদক কেনার টাকা না পেয়ে লিপ্ত হয়ে পড়ছেন সমাজবিরোধী অনেক কাজে। আগামীর ভবিষ্যৎ ওরাই। মাদকাসক্ত ব্যক্তি একটি সমাজ কিংবা পরিবারকে ধ্বংসের শেষপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এই বিষাক্ত থাবায় আক্রান্তের আবার বিরাট একটা অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তরুণদের একটা অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়লেও, তরুণদেরই আরেকটা অংশ মাদকমুক্ত সুন্দর সমাজ গড়তে কাজ করছেন। ২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবসকে সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক দেশের প্রথম মাদকবিরোধী ফোরামের গল্পকথন তুলে ধরেছেন—অরণ্য সৌরভ

নরসিংদীর ছেলে রাখিল খন্দকার নিশান। নিজের এলাকাতে মাদক, বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘তরুণ উদীয়মান সামাজিক সংগঠন’। ২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুবাধে পাড়ি জমান ঢাকা। কিন্তু ক্যাম্পাসে এসে তিনি হতাশ হয়ে পড়ে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণরা মাদকে আসক্ত। এছাড়া তিনি দেখতে পান অনেকেই এটিকে স্মার্টনেস হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তরুণদের এমন পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করার পরই সিদ্ধান্ত নেন এর বিরুদ্ধে কিছু করার। খোঁজ-খবর কিংবা এক প্রকার গবেষণা করে দেখেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দেশে কোনো মাদকবিরোধী ফোরাম, ক্লাব বা সংগঠন নেই। তখনই তিনি চিন্তা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক প্রথম মাদকবিরোধী ফোরামের মাধ্যমে মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক কাজের নতুন এক দিগন্ত বা ভিত্তি স্থাপন করার। এটি ২০১৪ সালের কথা।

সেই সময়ই কয়েকজন বন্ধু, ছোট ভাই-বোনদের সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন ‘স্টামফোর্ড মাদকবিরোধী ফোরাম’। আনঅফিশিয়ালি কার্যক্রম পরিচালনার এক পর্যায়ে ২০১৬ সালের প্রায় শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অফিশিয়ালি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্বতন্ত্র ফোরাম হিসেবে কাজ করার চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। মূলত সেই থেকেই পথচলা শুরু। ১৫-২০ জনের একটি দল নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ২০১৬ সালে অফিশিয়ালি যাত্রার সময় সদস্য ছিল ৪৭ জন। বর্তমানে ফোরামে যুক্ত আছেন ৩০০-এর অধিক শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক মাদকবিরোধী ফোরাম করার পেছনের গল্প বলতে গিয়ে প্রতিষ্ঠাতা রাখিল খন্দকার নিশান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরাই আগামীর বাংলাদেশ। আর আগামীর বাংলাদেশ তো মাদকাসক্ত হতে পারে না। তারা যদি ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয় তাহলে দেশের হাল ধরবে কে? এই ভাবনা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ফোরাম করার ভাবনা। এছাড়া ক্যাম্পাসে প্রতি বছর একটি ফোরাম হিসেবে কয়েকটি সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করলে শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি সচেতন হওয়ার সুযোগও থাকে। তাছাড়া মাদকবিরোধী ফোরামে সদস্য হলে, তারা মাদক থেকে দূরে থাকবে এবং সহপাঠীসহ নিজ নিজ এলাকাতেও এই সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেওয়া সহজ হওয়ার কারণও ছিল।

মাদকবিরোধী ফোরাম প্রতিষ্ঠার পেছনে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত প্রফেসর ড. এম. এ হান্নান ফিরোজ অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছিলেন বলে জানান ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি রাখিল খন্দকার নিশান। চ্যালেঞ্জিং ফোরাম হিসেবে তাদের সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বর্তমান বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ফাতিনাজ ফিরোজ, ফোরামের বর্তমান কনভেনর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য ড. ফারাহনাজ ফিরোজ ও স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ারের অ্যাডভাইজর রেহানা আক্তার।

ফোরামটি মূলত তরুণ শিক্ষার্থীদের সচেতন করার লক্ষ্যে কাজ করে থাকেন। শিক্ষার্থীদের তাদের কার্যক্রমে আকৃষ্ট করার জন্য মাদকবিরোধী কনসার্ট, মোটিভেশনাল সেশন, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তব্য প্রতিযোগিতা, মাইম, আলোচনা সভা, র্যালি, ফেস্টুন বিতরণ, মাদকবিরোধী ভাম্যমাণ প্রচারণা, মাদকবিরোধী দিবসে ভিন্নধর্মী আয়োজনসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন।

সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ থাকেন ফোরামটি। সেজন্য তাদের কোন কাজটি উল্লেখযোগ্য সেদিকে নজর দেন না বলে জানান রাখিল। ‘ইয়াং হিরোজ’, ‘তারুণ্যের বাংলাদেশ’, ‘তারুণ্যের জয়গান’সহ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ফোরামটি। এছাড়া ফোরামটি ‘হোয়াইট হার্ট অ্যাওয়ার্ড’ চালু করেন, যা ৫টি পর্যায়ে এই অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে থাকে।

পজিটিভ তরুণসমাজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে দেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য ভিন্নধারার কিছু করার প্রয়োজনবোধ থেকেই ভিন্নধর্মী কাজের মাধ্যমে কিছু মানুষের চিন্তায় পরিবর্তন আনতে পেরেছেন বলে মনে করেন রাখিল খন্দকার।

মাদকের মতো চ্যালেঞ্জিং কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। তবুও তিনি থমকে যাননি। কারণ তিনি মনে করেন, সমালোচনা ও বাঁধাই হচ্ছে ভালো কাজের অনুপ্রেরণা।

স্টামফোর্ডে ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন মাদকবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে-জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ইউআইইউ, পিপলস ইউনিভার্সিটি, আশা ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটিসহ আরো অনেক ইউনিভার্সিটি। এছাড়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে মাদকবিরোধী ফোরামও গঠন করছেন বলে জানান রাখিল খন্দকার।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্টামফোর্ড মাদকবিরোধী ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি রাখিল খন্দকার নিশান বলেন, দেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য সুন্দর সুস্থ একটি পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে থাকবে না কোনো মাদকের হাতছানি। স্বপ্ন দেখি সুন্দর তারুণ্য নির্ভর মাদকমুক্ত আগামীর বাংলাদেশের।

বর্তমান সভাপতি মুনতাসীর আলম বলেন, যুবসমাজকে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন সভা সেমিনার ও সচেতনতামূলক প্রোগ্রামের আয়োজন করে থাকি। এছাড়া যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমেও কার্যক্রম পরিচালনা করছি। মাদক কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না, মাদক জীবনে শুধুই ধ্বংস ডেকে আনে। তাই সকলে মাদককে না বলুন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads