বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখক জুল ভার্ন তার ‘টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগ আন্ডার দ্য সি’তে প্রথম সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজের ধারণা দেন বলে সবারই জানা। কিন্তু ডুবোজাহাজের প্রাথমিক ধারণা আসে আরো অনেক আগেই। ১৫৬২ সালে রাজা পঞ্চম চার্লসের উপস্থিতিতে ২ জন গ্রিক প্রথম সাবমারসিবলের (অর্ধ ডুবোজাহাজ) মতো একটি কাঠামো তৈরি করে। এটিকে দাঁড় টেনে চালাতে হতো। পরে ১৫৭৮ সালে ইংরেজ গণিতবিদ ব্রুনো আর ১৫৯৭ সালে স্কটিশ গণিতবিদ নেফিয়ার তাদের বইয়ে ডুবোজাহাজ নিয়ে ধারণা দেন। তবে ১৮ শতকের শেষদিকে বাণিজ্যিকভাবে ডুবোজাহাজ তৈরির কাজ শুরু হয়।
ডুবোজাহাজের এই ইতিহাস অনেকেরই জানা। কিন্তু সেটির গঠন কেমন বা কাজ করে কী উপায়ে তা অনেকেরই জানা নেই। তাই চলুন জেনে নেওয়া যাক ডুবোজাহাজের গঠন ও কাজের কৌশল।
গঠনপ্রণালি
সাবমেরিনের সামনের দিকে চোখা ও চ্যাপ্টা অংশটির নাম ‘বো বা নাক’। আর নাকের নিচে থাকে সোনার ড্যাম। এটি আশপাশের বস্তুর আকৃতি, দূরত্ব ও অবস্থান সম্পর্কে ধারণা নেয়। এদের মাঝে আছে চেইন লকার নামে একটি অংশ, যা ডুবোজাহাজকে কোথাও নোঙর করতে ব্যবহূত হয়।
এদের পেছনেই থাকে টর্পেডো কক্ষ। সাধারণত এখানে তিনটি টর্পেডো নিক্ষেপক থাকে। পাশাপাশি কয়েক রাউন্ড বাড়তি টর্পেডো রাখার জায়গাও থাকে। ডুবোজাহাজের পেছনের দিকেও এমন একটি ঘর থাকে। পার্থক্য হলো ওই ঘরে দুটি নিক্ষেপক থাকে। তবে উন্নত মডেলে এর পরিমাণ বাড়তে পারে।
টর্পেডো ঘরের পেছনেই অফিসারদের থাকার জায়গা। এর নিচে থাকে ডুবোজাহাজের ব্যাটারির স্থান। তার নিচেই থাকে জাহাজের চালিকাশক্তির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি। এই তেলের ঘরটি আসলে ওই প্রস্থচ্ছেদের সাবমেরিনের পুরো অংশ জুড়েই খোলসের মতো থাকে। তেল ডুবোজাহাজের ভারসাম্য রক্ষাতেও অবদান রাখে।
অফিসারদের ঘরের পেছনেই থাকে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। এখান থেকে পুরো সাবমেরিনকে পরিচালনা করা হয়। এর সঙ্গেই থাকে রেডিও রুম আর উপরে থাকে কনিং টাওয়ার। টাওয়ারের অংশ থেকে রেডিও এন্টেনা ও পেরিস্কোপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পেরিস্কোপের মাধ্যমে পানির নিচে থেকেই উপরের স্তরের জাহাজ বা অন্যান্য বস্তুর অবস্থান দেখে নেওয়া যায়।
নিয়ন্ত্রণকক্ষের নিচেই পাম্প রুম, যা দিয়ে পানি কমিয়ে বাড়িয়ে ডুবোজাহাজকে ডুবানো বা ভাসানো হয়। এর সঙ্গে লাগোয়া খোলস ঘরটি হচ্ছে ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক। সাধারণত সাবমেরিনের মডেল ও আকারভেদে চারটি বা তার অধিক ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক থাকে। সাবমেরিনের দুই পাশে দুটি ট্যাঙ্কের মতো অংশ থাকে। এগুলো হচ্ছে ট্রিম ট্যাঙ্ক বা ভারসাম্য শোধন ঘর।
নিয়ন্ত্রণকক্ষের পেছনেই থাকে নাবিকদের থাকার কক্ষ ও এর সঙ্গে লাগোয়া কর্মচারীদের কক্ষ। এদের নিচে একটি ব্যাটারি কক্ষ আছে। এর চারপাশে খোলসঘরে আছে তেল। এর পেছনেই ইঞ্জিন কক্ষ। মোট চার জোড়া ইঞ্জিন থাকে যারা তেল হতে শক্তি দিয়ে ডুবোজাহাজের পেছনের টারবাইন বা পাখা ঘোরায় এবং ব্যাটারি চার্জ করে। ব্যাটারির চার্জ দিয়ে পানির নিচে নিঃশব্দে চলা যায়।
ইঞ্জিনরুমের পেছনেই ম্যানুভারিং রুম নামে একটি অংশ থাকে যেখান থেকে পুরো ডুবোজাহাজের যন্ত্রপাতির অবস্থা, বিদ্যুৎ ও যান্ত্রিক চালিকা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ডুবোজাহাজের পেছনের দিকে রাডার নামে একটা বৈঠা থাকে যা দিয়ে এর গমন দিক নির্ধারণ করা হয়।
খোলসের ঘরগুলোয় যাওয়ার জন্য ডুবোজাহাজের ওপরের কাঠামো হতে কিছু চাকতি আকৃতির দরজা থাকে। টর্পেডো রুম হতে বের হওয়ার জন্যও এ ধরনের দরজা থাকে।
ডুবোজাহাজের কাঠামো সাধারণত এমন ধরনের লোহা সঙ্করে তৈরি হয় যেন তা পানির নিচে পানির চাপ সহ্য করতে পারে। সামনের দিকের আকৃতি এমন হয় যে তা যেন সহজেই পানি ভেদ করে এগুতে পারে।
চলন কৌশল
প্রথমেই সাবমেরিনের সামনের ব্যালাস্ট ট্যাঙ্কে অল্প পানি প্রবেশ করানো হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে মাঝের দুটি ও পেছনেরটিতে পানি প্রবেশ করানো হয়। তারপর ধীরে ধীরে ডুবা শুরু করলে ট্রিম ট্যাঙ্কে পানি কমবেশি করে ডুবোজাহাজের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা হয়। ভাসবার সময় পাম্প হতে উচ্চ চাপের বাতাস প্রবেশ করানো হয় ব্যালাস্ট ট্যাঙ্কে। তা দিয়ে ঠেলে পানিকে বের করে দেওয়ার মাধ্যমেই এটা ভেসে ওঠে পানির ওপরে। নাবিকদের জন্য প্রচুর রসদ, তেল ও সব ধরনের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে পানিতে ডোবার পর সোনার ও রাডারের মাধ্যমে পথ চিনে গুটিগুটি ছন্দে এগোয় গুপ্তবাহন এই ডুবোজাহাজগুলো। হারিয়ে যায় সমুদ্রের অতলে কয়েক মাসের জন্য।