ছবি : সংগৃহীত

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাসের পেছনের বিজ্ঞান

  • তপু রায়হান
  • প্রকাশিত ১৯ এপ্রিল, ২০১৮

সকাল থেকেই বেশ ঝকঝকে রোদেলা আবহাওয়া। বেশ ফুরফুরে মন নিয়ে পরিপাটি হয়ে বাসা থেকে বের হলেন। বাসস্ট্যান্ডে যেতে রিকশাও নিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে শুরু হলো প্রবল বাতাস। ধুলাবালিতে চারপাশ একাকার। একটু পরেই ঝমঝমিয়ে নামল বৃষ্টি। রিকশায় বসেই ধুলো-কাদায় আপনিও একাকার! পোশাক না বদলে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। অগত্যা আবার বাসায় ফিরতে হলো।

আমাদের দেশে বৈশাখ থেকে শুরু করে আশ্বিন মাস পর্যন্ত এভাবে বৃষ্টি বা ঝড় এসে সারা দিনের পরিকল্পনাকেই জলে ফেলে দিতে পারে। আর এ কারণেই প্রতিদিন সকালে লাখ লাখ মানুষ আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানার জন্য রেডিও শোনেন ও টেলিভিশন দেখেন কিংবা ইন্টারনেটে ঢুঁ মারেন। পূর্বাভাস শুনে ঠিক করেন কেমন কাপড় পরবেন, বের হওয়ার সময় ছাতা সঙ্গে নেবেন নাকি নেবেন না। আবার সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসে বাঁচা যায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি থেকেও।

কিন্তু আবহাওয়া সম্বন্ধে আগে জানিয়ে দেওয়া এতটা সহজ কাজ নয় বরং এটা কৌশল ও বিজ্ঞানের এক চমৎকার মিশ্রণ। আবহাওয়া সম্বন্ধে পূর্বাভাস দেওয়ার সঙ্গে কী কী জড়িত এবং এই পূর্বাভাসগুলো কতটা নির্ভরযোগ্য? এর উত্তর পেতে হলে আসুন আমরা প্রথমে পরীক্ষা করে দেখি কীভাবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়।

আবহাওয়া পরিমাপ করা

১৬৪৩ সালে ইতালির পদার্থবিজ্ঞানী এভানজেলিস্টা টরিসিলি আবিষ্কার করেন ব্যারোমিটার। আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বায়ুর চাপ ওঠানামা করে আর চাপ কমে যাওয়া ঝড়ের সঙ্কেত দেয় যন্ত্রটি। বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা পরিমাপের যন্ত্র হাইগ্রোমিটার ১৬৬৪ সালে আবিষ্কৃত হয়। এর প্রায় একশ’ বছর পর ফরাসি বিজ্ঞানী আনটোয়ান-লোরান ল্যাভৌসিয়ের আবিষ্কার করেন যে- প্রতিদিনের বায়ুর চাপ, আর্দ্রতা এবং বাতাসে গতি ও দিক পরিমাপ করে এক বা দুদিন আগে আবহাওয়া সম্বন্ধে প্রায় সঠিক খবর জানানো সম্ভব।

আবহাওয়ার দিক নির্ণয়

আবহাওয়াবিদরা যত বেশি উপাত্ত সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন, ততই তারা বুঝতে পেরেছিলেন আবহাওয়া খুবই জটিল বিষয়। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে অনেক আবহাওয়া কেন্দ্র আছে, যেখান থেকে রেডিয়োসন্ড সংবলিত বেলুন উড়িয়ে দেওয়া হয়। রেডিয়োসন্ড হলো এক ধরনের যন্ত্র, যা দিয়ে বায়ুমণ্ডলের অবস্থা পরিমাপ করা হয় ও তারপর ওই তথ্যগুলোকে রেডিওর মাধ্যমে আবার আবহাওয়াকেন্দ্রে জানিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া রাডার ব্যবহার করা হয়। বেতার তরঙ্গগুলো মেঘে বৃষ্টিকণা ও বরফকণায় আঘাত পেয়ে ফিরে আসে আর আবহাওয়াবিদরা তখন বুঝতে পারেন ঝড় কোনদিকে চালিত হচ্ছে।

তবে ১৯৬০ সালে যখন বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম আবহাওয়া উপগ্রহ টিরোস ১-কে টিভি ক্যামেরাসমেত আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন সঠিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে বিরাট অগ্রগতি হয়েছিল। এখন আবহাওয়ার কৃত্রিম উপগ্রহগুলো এক মেরু থেকে অন্য মেরু পর্যন্ত পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। অন্যদিকে ভূ-কেন্দ্রীয় কৃত্রিম উপগ্রহগুলো পৃথিবীর উপরিভাগে একটা নির্দিষ্ট অবস্থানে থাকে ও পৃথিবীর যে অংশটুকু এদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে আছে সেখানকার খবরাখবর জানাতে থাকে। দুই ধরনের উপগ্রহই ওপর থেকে দেখা আবহাওয়ার চিত্র সম্প্রচার করে।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পর ব্রিটিশ আবহাওয়াবিদ লুইস রিচার্ডসন অনুমান করেছিলেন, যেহেতু বায়ুমণ্ডল পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো মেনে চলে, তাই আবহাওয়া সম্বন্ধে আগে থেকে বলার জন্য তিনি গণিতশাস্ত্রকে ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু সূত্রগুলো এত জটিল ও গণনা করতে এত সময় লেগে যেত যে, পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য গণনা শেষ করার আগেই আবহাওয়া নির্ধারণের রেখাগুলো উধাও হয়ে যেত। এছাড়া রিচার্ডসন ছয় ঘণ্টা পর পর নেওয়া আবহাওয়ার উপাত্ত ব্যবহার করেছিলেন। ফরাসি আবহাওয়াবিদ রেনে শাবৌ বলেন, সঠিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট পর পর পরিমাপ করা দরকার।

কিন্তু কম্পিউটার আসায় বড় ও জটিল হিসাবগুলো তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হয়। আবহাওয়াবিদরা এক জটিল সংখ্যাসূচক নমুনা তৈরি করার জন্য রিচার্ডসনের হিসাব পদ্ধতিকে ব্যবহার করেছিলেন। জটিল সংখ্যাসূচক নমুনাটা হলো এক ধারাবাহিক গাণিতিক সমীকরণ, যার মধ্যে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে এমন সব ভৌত আইন রয়েছে।

এই সমীকরণগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য আবহাওয়াবিদরা পৃথিবীর উপরিভাগকে বর্গজালিতে ভাগ করেন। সম্প্রতি ব্রিটেনের আবহাওয়া অফিস পৃথিবীর যে মডেল ব্যবহার করে তাতে বর্গজালির বিন্দুগুলো প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে দূরে অবস্থিত। প্রতিটি বর্গের ওপরের বায়ুমণ্ডলকে বক্স বলা হয় আর বায়ুমণ্ডলের বায়ূপ্রবাহ, বায়ূর চাপ, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা ২০টি বিভিন্ন উচ্চতা থেকে পর্যবেক্ষণ করে রেকর্ড করা হয়।

সারা পৃথিবীতে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকেন্দ্র আছে ও সেগুলোর প্রত্যেকটির উপাত্তকে কম্পিউটার বিশ্লেষণ করে ও এর পরের ১৫ মিনিটে বিশ্বের আবহাওয়া কেমন হবে সেই বিষয়ে পূর্বাভাস দেয়। একবার এটা করা হয়ে গেলে পরের ১৫ মিনিটের আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্বন্ধে খুব তাড়াতাড়ি জানা যায়। একটি কম্পিউটার মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে সারা পৃথিবীর আগামী ছয় দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে পারে।

সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস

প্রযুক্তির বিবর্তনের আশীর্বাদে এখন ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপারে অনেক তথ্য জানতে পারছি আমরা। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং কম্পিউটার মডেলের কল্যাণে ঘূর্ণিঝড়ের ভেতরে কী চলছে তা-ও আমরা জানতে পারি। এসবের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়ার পদ্ধতিও হয়ে উঠেছে অনেক উন্নত। বিষুবীয় একটি ঘূর্ণিঝড় কোন পথে যাচ্ছে তা-ও আমরা এখন বুঝতে পারি।

ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দিতে ব্যবহার হয় বেশ কয়েকটি কম্পিউটার মডেল। এদের একেকটির ক্ষমতার মাঝে রয়েছে বেশ ফারাক এবং একেকটি একেক বিষয়ে পারদর্শী।

বর্তমানে প্রচলিত মডেলগুলো ঘূর্ণিঝড়ের চলার পথের পূর্বাভাস দিতে পারে সঠিকভাবেই। এর জন্য ব্যবহার করা হয় গ্লোবাল ডায়নামিক মডেল। এই মডেলগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য নিয়ে এগুলোকে একটি সমীকরণের মাঝে ফেলা হয় এবং এ থেকে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়টি সেখানে গিয়ে পড়ার পর কী তাণ্ডব চালাবে সে সম্পর্কে ভালো কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

কোনো একটি ঘূর্ণিঝড়ের শক্তিমাত্রা পরিমাপ করার জন্য সাধারণত একটু কম আধুনিক, পরিসংখ্যানভিত্তিক মডেলগুলো দিয়ে কাজ চালানো হয়। যে ঝড়টি চলছে তা থেকে তথ্য নিয়ে এটি একটি গড়পড়তা উত্তর দেয়। জানা যায়, ওই অবস্থানে এবং বছরের ওই সময়ে এমন যেকোনো ঝড়ের শক্তি কেমন হতে পারে। এই মডেলগুলো সহজে কাজ করে এবং সময়ও কম লাগায়। কিন্তু সমস্যা এখানেই যে, এদের পূর্বাভাসগুলো হয় দুর্বল।

এ ছাড়া খুব হাই-টেক মডেলে আছে এবং এগুলো ব্যবহার করে অনেক তথ্য কিন্তু ফলে এগুলো হয়ে যায় ভীষণ শ্লথগতির। একটি ঝড়ের ফলে যখন মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়েছে তখন এতটা সময় আসলে পাওয়া যায় না এবং বাধ্য হয়েই কম সময়ে পূর্বাভাস দিতে হয় আবহাওয়াবিদদের।

এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের সঠিক পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি বাধা হলো- ঘূর্ণিঝড় ঠিক কীভাবে কাজ করে তা এখনো আমাদের কাছে রহস্য। যেমন আমরা জানি যে, ঘূর্ণিঝড়ের ঠিক মাঝে রয়েছে এর কেন্দ্র বা ‘চোখ’ এবং ঘূর্ণিঝড় যখন তাণ্ডব চালায় চারদিকে তখন এই চোখের ভেতরের স্থান থাকে আশ্চর্য রকমের শান্ত। কিন্তু সম্প্রতি জানা গেছে, এই চোখকে বাইরের অশান্ত পরিবেশ থেকে রক্ষা করে যেই বাতাসের দেয়াল তা নিরবচ্ছিন্ন নয় এবং এটি ভেঙে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই আবার নতুন করে গঠিত হতে পারে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে প্রভাব পড়তে পারে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তির ওপরে। এই ঘটনাটি কখনো ঘূর্ণিঝড়কে করে ফেলে দুর্বল, আবার কখনো তাকে করে তুলে আরো বিধ্বংসী। এ রকম আকস্মিক বিষয়গুলোকে মডেলের ভেতরে আনা সম্ভব নয় এবং এগুলোর ফলে সৃষ্ট তারতম্যও তাই রয়ে যায় হিসাবের বাইরে। এসব কারণে শত হিসাব-নিকাশ সত্ত্বেও দেখা যায় পূর্বাভাসগুলো অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে যায় ভুল। ঘূর্ণিঝড়গুলোকে আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য তাই মানুষ এবার দূর থেকে জল্পনা-কল্পনা বাদ দিয়ে বিমান নিয়ে যাচ্ছে ঠিক এর মধ্যভাগে এবং এই কাজগুলো আরো ভালোভাবে করা গেলে হয়তো ভবিষ্যতে আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads