মুক্তমত

জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে

  • প্রকাশিত ১৭ জুলাই, ২০২১

মো. আকিব হোসাইন

 

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। পৃথিবীতে জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। বর্তমানে জনসংখ্যায় শীর্ষস্থানে রয়েছে চীন। বাংলাদেশ ভূ-আকৃতির দিক থেকে ছোট হলেও জনসংখ্যার ঘনত্ব কিন্তু বেশি। এ নিয়ে রয়েছে নানান আলোচনা এবং সমালোচনা। জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৯০ সালের ১১ জুলাই থেকে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালন করা হচ্ছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এবারো ১১ জুলাই সারা বিশ্বে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হলো। জাতিসংঘ কতিপয় বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। যেমন, পরিবার পরিকল্পনা, লৈঙ্গিক সমতা, দারিদ্র্য, মাতৃস্বাস্থ্য এবং মানবাধিকার ইত্যাদি।

বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদেরও জনসংখ্যার সমস্যার সমাধানের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হলো জনসংখ্যাস্ফীতি। যদিও বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৪তম অথচ দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব ব্যাপক। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি ৯১ লাখের মতো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৬ বছর। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। দেশে মৃত্যুহারের চেয়ে জন্মহার অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিক জনসংখ্যা পৃথিবীর যে-কোনো দেশ বা জাতির কাছে অভিশাপস্বরূপ। আবার স্বল্প জনসংখ্যাও দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শূন্যতা বহন করে। জনসংখ্যাস্ফীতি বর্তমানে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। কেননা অধিক জনসংখ্যার প্রভাবে বিদ্যমান মৌলিক অধিকারগুলো—খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বিনোদন থেকে অধিকাংশ জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হচ্ছে। আবার অধিক জনসংখ্যার ফলে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। যেখানে একটি দেশে উৎপাদিত সম্পদ মোট জনগোষ্ঠীর অভাব মিটিয়ে বাড়তি অংশ রপ্তানি করে বৈদেশিক অর্থ আয় করার কথা। সেখানে অধিক জনগোষ্ঠীর অভাব মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। অধিক জনসংখ্যার প্রভাবে বস্ত্রের সমস্যাও দেখা দেয়। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারগুলোতে এমন সংকট দেখা যায়।

তা ছাড়া বাসস্থানের কথা যদি বলি তাহলে বর্তমানে অধিক জনসংখ্যার প্রভাবে অনেকে বাসস্থান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাস্তার পাশে কিংবা রেললাইনের ছাউনির নিচে অতি কষ্টের সাথে জীবনযাপন কাটাতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প জাতিকে আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। শিক্ষাগ্রহণ করা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার, অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠতার এই দেশে বর্তমানে হাজার হাজার শিশু শিক্ষাগ্রহণ করতে পারছে না। দরিদ্রতার কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে নিম্ন-আয়ের মানুষ। আবার পারিবারিক সচেতনতার অভাবে শিক্ষাবিমুখ হয়ে পড়ছে পশ্চাৎপদ সমাজের মানুষ। আবার অনেক শিশুরা সামাজিকীকরণের অভাবে শিশুশ্রমে যুক্ত হচ্ছে, যা দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।

অন্যদিকে অধিক জনসংখ্যার ফলে চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে হাসপাতাল ও ডাক্তারের সংখ্যা কম হওয়ায় এবং রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অত্যধিক জনসংখ্যা ও দারিদ্র্যের কারণে মানুষ চিকিৎসা নামক মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া বিনোদনের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত সিংহভাগ মানুষ। দুঃখজনক হলেও সত্য বটে, শিশু থেকে বয়স্ক সর্বস্তরের মানুষ বিনোদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যার অন্যতম কারণ হলো সংখ্যাধিক্য জনসংখ্যা। সংখ্যাধিক্যে জনসংখ্যার কথা যদি আমরা ব্যাখ্যা করি তাহলে রাজধানী ঢাকার কথা বলতে হবে। কেননা ঢাকা যদিও দেশের প্রাণকেন্দ্র কিন্তু প্রয়োজনের অধিক মানুষ ঢাকায় বসবাস করে। এই শহর এখন অ-বসবাসযোগ্য শহরে পরিণত হয়েছে। গ্রামের মানুষ কর্মসংস্থানের উদ্দেশে শহরমুখী হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যার প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ। আয়তন ৩০৬ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যায় দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় শহর এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম শহরের মধ্যে অন্যতম, যা বাংলাদেশে জন্য হুমকিস্বরূপ কিংবা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিক জনসংখ্যার ঢাকায় বর্তমানে যানজট সমস্যা একটি অন্যতম সমস্যা। তাছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নির্মাণ কিংবা অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ এবং অধিক শিল্প কলকারখানা সৃষ্টির মাধ্যমে ঢাকা শহর বর্তমানে নানান সমস্যায় জর্জরিত। কলকারখানার সৃষ্টির মাধ্যমে এসব শিল্প-কারখানার ধোঁয়ায় ঢাকা শহর দূষিত নগরীতে পরিণত হয়েছে। শিল্প কলকারখানার বর্জ্য রাস্তার পাশে ফেলে পরিবেশ বিনষ্ট করার পাশাপাশি মাটি দূষিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের জীবনে ভোগান্তি বাড়তেছে।

এছাড়া অধিক জনসংখ্যার বাংলাদেশে বর্তমানে বেকারত্বের হার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও তৈরি হচ্ছে না দক্ষ জনশক্তি। ফলে প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। অধিক জনসংখ্যার কুফল অনুধাবন করতে হবে। বর্তমান বিশ্বে তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে দক্ষ ও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। দেশের উন্নয়নে সুদক্ষ নাগরিকে রূপান্তরিত করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এই জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে বিভিন্ন তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সেমিনারের আয়োজন করতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে বাল্যবিবাহ। বর্তমানে বাল্যবিবাহ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য একটি অন্যতম সমস্যা। এসব সমস্যার সমাধানে আমাদেরকে এগিয়ে আসত হবে। এক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের সোচ্চার হতে হবে। অভিভাবকদের বাল্যবিবাহের ভয়াবহতা অনুধাবন করতে হবে। বাল্যবিবাহ রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

মনে রাখতে হবে, অধিক জনসংখ্যার ফলে তাদের প্রয়োজনীয় অধিকার নিশ্চিতকরণ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আসুন, অধিক জনসংখ্যার দেশে বিপুল এই জনগণকে জনসম্পদে রূপান্তর করি। জনসংখ্যাকে প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত নাগরিক তৈরিতে তৎপর হই। সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমেই সম্ভব দেশকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দেওয়া এবং দেশের নাগরিকদের সুনাগরিকে পরিণত করা।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads