মুক্তমত

রাজনৈতিক সংকটে হাইতি

  • প্রকাশিত ১৭ জুলাই, ২০২১

খন্দকার তানবীর

 

ক্যারিবিয়ান দেশ হাইতিতে ঘটে গেছে ট্র্যাজেডি। গত ৭ জুলাই মধ্যরাতে কিছু অস্ত্রধারী হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মইসের পোর্ট অব প্রিন্সের বাড়িতে ঢুকে তাকে হত্যা করে। এতে তার স্ত্রী গুরুতর আহত হন। পুলিশের গুলিতে চার সন্দেহভাজন নিহত হয় এবং পরে আরো দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবেশী দেশ ডোমিনিকান রিপাবলিক হাইতির সঙ্গে তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। প্রেসিডেন্ট হত্যাকাণ্ড দেশটির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিক সংকটকে আরো গভীর করে তুলেছে।

একসময় হাইতি ছিল ফ্রান্সের সবচেয়ে সমৃদ্ধ উপনিবেশ, তখন চিনি ও কফি শিল্পের রমরমা অবস্থা ছিল। সেই হাইতি এখন পশ্চিম গোলার্ধের দরিদ্রতম রাষ্ট্র। ২০১০-এর ভূমিকম্পে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং একই সঙ্গে অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২০১৬ সালে হারিকেন ম্যাথিউ ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। তাছাড়া কলেরাসহ বিভিন্ন রোগে কাহিল হাইতির জনগণ। সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারি দেশেটির স্বাস্থ্য খাতের আরো বেহাল দশা করেছে। এখনো ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়নি।

ফল রপ্তানির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত জোভেনেল মইস ২০১৫ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। নানান অভিযোগে সেই নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করে ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন হয় এবং মইস পুনরায় নির্বাচিত হন। ফেব্রুয়ারি ২০১৭-তে তিনি শপথ গ্রহণ করেন। মইস প্রেসিডেন্ট হতে না হতেই বিতর্ক শুরু হয়। বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির অভিযোগে ব্যাপক বিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটে। অভিযোগ আছে মইস সরকারের শীর্ষ সদস্যরা কোটি কোটি ডলারের বিদেশি সহায়তায় জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

পার্লামেন্ট নির্বাচন বারবার পেছানোর কারণে জানুয়ারি ২০২০ থেকে প্রেসিডেন্ট মইস আদেশ (ডিক্রি) জারির মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করছিলেন। বিরোধী দলের নেতারা তার একচ্ছত্র কর্তৃত্বাধীন নতুন গোয়েন্দা সংস্থা গঠনের কথা উল্লেখ করে মইসকে অভিযুক্ত করেছেন একনায়কতান্ত্রিক শাসক হিসেবে। তাকে নিয়ে আরো অভিযোগ হচ্ছে—তিনি সংবিধান পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্টের দায়মুক্তির বিধান আনতে চেষ্টা করেছিলেন।

বিচার বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং সুশীলসমাজের সদস্যরা মইসের বৈধতা নিয়ে বার বার প্রশ্ন তুলেছেন এবং বলেছেন ২০১৫ সালে প্রথম নির্বাচিত হওয়ার সময় থেকে শাসনকাল হিসাব করতে হবে। সেই হিসেবে ফেব্রুয়ারি ২০২১-এ প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু মইস এবং তার সমর্থকদের দাবি শাসনকাল শুরু হয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০১৭ থেকে এবং শেষ হবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। গত বছর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ, যুক্তরাষ্ট্র এবং অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস সাধারণ নির্বাচনের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু হাইতির সুশীলসমাজের বক্তব্য হলো-খাদ্যের অপর্যাপ্ততা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মহামারির কারণে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয় যখন মইস তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ ও বিতর্ককে ‘রাষ্ট্রবিরোধী বিদ্রোহের প্রচেষ্টা’ ও এক অবৈধ সরকার কায়েমের ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেন। পরে তার আদেশে রাষ্ট্রের ২৩ জন গুরুত্বপূর্ণ নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়, যার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন। অবশেষে ২০২১ সালে এসে রাজনৈতিক অস্থিরতায় হাইতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মুহুর্মুহু আন্দোলনে কেঁপে উঠছে হাইতির রাজপথ। এরকম পটভূমিতে প্রেসিডেন্ট মইস হত্যাকাণ্ড হাইতির রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে গভীরতর করে তুলবে। আইন বিভাগ অকার্যকর হয়ে আছে, বৈধভাবে মইসির স্থলাভিষিক্ত কে হবেন সেটা কেউ জানে না। এখন ক্লদ জোসেফ এপ্রিল ২০২১ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।

আগামী কয়েক মাসে হাইতির সংকট হয়তো কাটবে না। সেপ্টেম্বরে পার্লামেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আগামী নির্বাচনের আগে কে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হবেন—তার মীমাংসা করা। কারণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিধিবিধান অস্পষ্ট। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদে আসীন ব্যক্তি অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে এলে সেটা হয়তো যুক্তিসঙ্গত হতো, কিন্তু তিনি অতিসম্প্রতি কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। অন্যদিকে ক্লদ জোসেফ এই পদের জন্য বিকল্প হতে পারেন, সেক্ষেত্রে পার্লামেন্টের অনুমোদন লাগবে।  কিন্তু গত বছর ভেঙে যাওয়ার পর থেকে পার্লামেন্ট অকার্যকর অবস্থায় আছে। তার ওপর আবার নতুন বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়েছে। নিহত হওয়ার  কিছু সময় আগে মইস এরিয়েল হেনরি নামের অন্য আরেকজনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছিলেন। ফলে দুজনেই প্রধানমন্ত্রীর পদ দাবি করছেন। সংকট ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।

যদিও অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্লদ জোসেফ শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। অতীতের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, হাইতির এই রাজনৈতিক শূন্যতা অত্যন্ত বিপজ্জনক। সহিংসতা দ্রুত বাড়তে পারে। হাইতির প্রেসিডেন্ট মইস  হত্যাকাণ্ড দেশটিকে এক ক্রান্তিকালের দিকে ঠেলে দিয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সুশীলসমাজ একত্রিত হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে আনতে পারবে কি না তা একমাত্র সময়ই বলে দেবে। 

 

লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads