চাটমোহরসহ চলনবিলের বাতাসে এখন শুঁটকি মাছের গন্ধ। দেশের সবচেয়ে বৃহৎ জলাভূমি মিঠে পানির মৎস্য ভান্ডার চলনবিল। প্রতি বছরের মত এবারও বিলে-নদীতে মাছ ধরার উৎসব চলছে। বিল থেকে পানির সঙ্গে ছুটছে মাছ নদীর দিকে। সেই মাছ কিনে চাতালে শুকানোর মৌসুম শুরু করেছে চাতাল মালিকরা। এই বিলের সুস্বাদু শুঁটকি মাছের বেশ চাহিদা দেশে-বিদেশে। রফতানি হচ্ছে আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে।
এক সময় যখন চলনবিলের মাছ স্থানীয় অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় বিপুল প্রভাব ফেলত। মাছ বিক্রি করে আর্থিক সচ্ছলতা আসতো বিলাঞ্চলের মানুষের। চলনবিলের মাঝ দিয়ে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জের রেলপথও গড়ে ওঠে প্রকৃতির এই মৎস্যভান্ডারকে ঘিরেই। তখন চলনবিলের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে বাঘাবাড়ী থেকে সিংড়া পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ২০০২ সালে চলনবিলের বুক চিরে নির্মাণ করা হয় ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বনপাড়া-হাটিকুমরুল-যমুনা সেতু সংযোগ মহাসড়ক।
চলনবিলে রয়েছে মোট প্রায় ১ হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯ টি বিল, ৪২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬ টি নদী, ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২ টি খাল এবং অসংখ্য পুকুর। চলনবিলের জেলে, ব্যবসায়ী ও নারী-পুরুষ শ্রমিকেরা এখন মাছ ধরা ও শুকানোয় ব্যস্ত সময় পার করছেন। দেশি মাছকে কেন্দ্র করে চলনবিলে গড়ে উঠেছে ৩শ’ টি অস্থায়ী শুঁটকির চাতাল।
চাটমোহরের নটাবাড়িয়া গ্রামের ব্যবসায়ী আরশেদ আলী শুঁটকির চাতাল গড়েছেন তাড়াশের মহিষলুটি মাছের আড়তের পাশে। তিনি জানায়, গত বছর তার চাতালে ৬৫০ থেকে ৭শ’ মণ শুঁটকি উৎপাদন হয়েছিল। সৈয়দপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ীরা এসে চাতাল থেকেই শুঁটকি কিনে নিয়ে যায়।
চাটমোহরের খলিশাগাড়ী বিলপাড়ের চাতাল মালিক আজগর আলী জানান, এবার তার চাতালে শুঁটকির উৎপাদন বেশি হতে পারে। কারণ মাছের পরিমান বেশি। সোঁতিবাঁধ পাতা হয়েছে গত মৌসুমের চেয়ে বেশি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র গুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি শুঁটকি মৌসুমে এসব চাতাল থেকে প্রায় ১শ’ কোটি টাকা মূল্যের ২৯০ থেকে ৩শ’ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। শুঁটকির মানভেদে এ বি ও সি গ্রেডে বাছাই করা হয়। ‘এ’ গ্রেডের শুঁটকি মাছ আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহরাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ২৫ টি দেশে রফতানি করা হয়।
সাধারণতঃ এসব দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে রয়েছে চলনবিলের সুস্বাদু শুঁটকির ব্যাপক সমাদর। তা ছাড়া ‘সি’ ও ‘বি’ গ্রেডের শুঁটকি মাছ দেশের ভেতরে দিনাজপুর, সৈয়দপুর, নীলফামারী, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে উচ্চ মূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে।
সৈয়দপুরের শুঁটকি ব্যবসায়ী এখলাছ উদ্দিন মিয়া জানান, চলনবিলের শুঁটকির মান ভালো, স্বাদ বেশি। তাই দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আশ্বিন মাসের শুরুতেই শুঁটকির চাতাল পড়তে শুরু করে। অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত পানি না শুকোনো পর্যন্ত চাতালগুলো চালু থাকে। ইতিমধ্যেই মাছ শুঁটকি দেওয়া শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শুঁটকি তৈরির চাতাল মালিকেরা এখানে চাতাল পেতেছেন বিলে বা নদীর সোঁতির আশেপাশে।
তিন থেকে ছয় লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে এ ব্যবসায় শুরু করা যায় বলে জানান হান্ডিয়াল গ্রামের শুঁটকি ব্যবসায়ী আরেপ আলী। তিনি জানান, পানি কমতে থাকালে চলনবিলের বিভিন্ন স্থানে সোঁতিজাল পাতা হয়। তখন ধরা পড়ে পুঁটি, খলসে, চেলা, টেংরা, বাতাসি, চিংড়ি, নলা, টাকি, গুচি, বাইম, বোয়ালসহ নানা জাতের মাছ। এসব মাছ কিনে অথবা নিজেরা চাতালে শুকিয়ে উৎপাদন করা হয় শুঁটকির। পরে এই শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করে পাঠানো হয়, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
চলনবিলের দুই সহস্রাধিক পরিবার মৌসুমি এই শুঁটকি তৈরির কাজে জড়িত রয়েছেন। এসব পরিবারের নারী-পুরুষ দিন হাজিরা কাজ করেন শুঁটকি চাতালগুলোয়। এ কাজ করে তারা আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছেন। শুঁটকি তৈরির কাজে নিয়োজিত আলেয়া, তাহমিনা, কাদের আলী, সমশের মিয়াসহ বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ শ্রমিক জানান, তিন কেজি তাজা মাছ শুকিয়ে এক কেজি শুঁটকি তৈরি হয়। প্রকার ভেদে শুঁটকির বাজারমূল্য ২শ’ টাকা থেকে এক হাজার ২ হাজার টাকা।
বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটির শুঁটকির আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই মহাসড়ক নির্মাণের আগে চলনবিল থেকে আহরিত বিপুল পরিমাণ মাছ অবিক্রিত থেকে যেত। এসব মাছ পরে শুঁটকি করা হতো অথবা ফেলে দেয়া হতো। তখন উদ্বৃত্ত মাছ স্বল্প মূল্যে কিনে শুঁটকি তৈরি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অনেক শুঁটকি চাতাল মালিক বড় অঙ্কের টাকা উপার্জন করতেন। আর এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা চলনবিলের তাজা মাছ ও শুঁটকি মাছ কিনে ট্রাকে নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন জেলায়।
শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানান, শুঁটকি ব্যবসায় জড়িত হয়ে তারা আর্থিকভাবে সচ্ছলতার দেখা পেয়েছেন ঠিকই; তবে এ ব্যবসায় ঝুঁকিও অনেক বেশি। ঠিকমতো শুঁটকির পরিচর্চা করতে না পারলে অনেক ক্ষেত্রে শুঁটকি পোকা লেগে নষ্ট হয়ে যায়। আবহাওয়া খারাপ হলে, রোদ না থাকলে বিপদে পড়তে হয় শুঁটকি নিয়ে তাদের। তখনই মূলধন খোয়ানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। চাটমোহরসহ চলনবিল এলাকায় শুঁটকি চাতালগুলো এখন সরগরম। রাত দিন পরিশ্রম করছেন নারী-পুরুষ।