মুফতি আবদুল্লাহ তামিম
পবিত্র কোরআনুল করিমে সুলাইমান (আ.) ও পিপীলিকার কথোপকথনের উল্লেখ আছে। আমরা এই ছোট্ট প্রাণীটিকে পিঁপড়া, পিঁপড়ে বা পিপীলিকা বলে চিনি। ইংরেজিতে (অহঃ) আরবিতে (নামলাতুন) বলা হয়। বৈজ্ঞানিক নাম ফর্মিসিডিয়া (ঋড়ৎসরপরফধব)।
পিঁপড়ার বংশ পরিচয় : ফর্মিসিডিয়া (ঋড়ৎসরপরফধব) গোত্রের অন্তর্গত সামাজিক কীট বা পোকা বলা হয় তাকে। পিঁপড়া এদের ঘনিষ্ঠ প্রজাতি বোলতা ও মৌমাছির মতো একই বর্গ হাইমেনোপটেরা (ঐুসবহড়ঢ়ঃবৎধ) অন্তর্গত। এরা মধ্য-ক্রেটাশাস পর্যায়ে ১১ থেকে ১৩ কোটি বছর আগে বোলতা জাতীয় প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়। এখন পর্যন্ত জানা প্রায় ২২ হাজার পিঁপড়া প্রজাতির মধ্যে ১২ হাজার ৫০০টির শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। ভেসপয়েড বোলতাদের একটি বংশধারা থেকে পিঁপড়াদের বিবর্তন ঘটেছে। জীবাশ্মের রেকর্ড থেকে জানা গেছে, ১৫ কোটি বছর আগে অর্থাৎ জুরাসিক যুগের শেষদিকেও তাদের অস্তিত্ব ছিল। ১০ কোটি বছর আগে সপুষ্পক উদ্ভিদের বিকাশের পর তারা আরো বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে এবং আনুমানিক ৬ কোটি বছর আগে বাস্তুতান্ত্রিক প্রতিপত্তি অর্জন করে। ১৯৬৬ সালে উইলসন ও তার সহকর্মীরা ক্রিটেশাস যুগের একটি পিঁপড়ার জীবাশ্ম আবিষ্কার করেন। কোরআনের মাধ্যমে আরো কিছু তথ্য পাওয়া যায়, কোরআনে বর্ণিত পিঁপড়া (স্ত্রী) বলেছিল। বাসার বাইরে স্ত্রী পিঁপড়া থাকে, পুরুষ পিঁপড়া নয়। আমরা এখন জানি স্ত্রী পিঁপড়ারা কর্মী পিঁপড়া, পুরুষরা শুধুই প্রজনন কাজের জন্য বেঁচে থাকে।
পিঁপড়ার পরিচয় : কালো পিঁপড়া লাল পিঁপড়া। কত ধরনের আর কত রঙের পিঁপড়া দেখা যায় আমাদের দেশে। আর কত হাজার প্রজাতির পিঁপড়ার ইতিহাস লেখা আছে জানা নেই কারো। তবে গণনায় এসেছে মাত্র ৮ হাজার প্রজাতির। আর আমাদের দেশে তো মাত্র ২৫০ প্রজাতির পিঁপড়া দেখা যায়। দেখতে ছোট কালো পিঁপড়া লাল পিঁপড়া সৈনিক পিঁপড়া। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় গুলি পিঁপড়া (ইঁষষবঃ অহঃ), বুলডগ পিঁপড়া (ইঁষষফড়ম অহঃ), সৈনিক পিঁপড়া (অৎসু অহঃ), আর্জেন্টিনার পিঁপড়া (অৎমবহঃরহব অহঃ), আগুন পিঁপড়া (ঋরৎব অহঃ)। পিঁপড়ারা দলবদ্ধভাবে থাকতে ভালোবাসে। কালো পিঁপড়া ১৫ বছর, লাল পিঁপড়া ৪-১২ বছর পর্যন্ত বাঁচে। সাধারণত এদের দৈর্ঘ্য ০.৬৪ থেকে ২.৫ সে.মি. পর্যন্ত হয়। কিছু প্রজাতি ০.৫-০.৭ সে.মি. হয়ে থাকে। বড় প্রজাতির পিঁপড়া ১০ থেকে ১২ সে.মি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো, তারা দূরে থাকা পিঁপড়ার সঙ্গে মাথার ওপর থাকা অ্যান্টেনার মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে।
পিঁপড়া সম্পর্কে অজানা তথ্য : পিঁপড়ার কান নেই। মানুষের মতো পিঁপড়ার কিন্তু কান নেই। তাদের হাঁটু আর পায়ে আছে বিশেষ সেন্সিং ভাইব্রেশনস, যার মাধ্যমে তারা আশপাশের পরিস্থিতি বুঝতে পারে। পোকামাকড়দের মধ্যে সবচেয়ে বড় মস্তিষ্কের অধিকারী তারা। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় এদের মস্তিষ্কে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজারটি কোষ বেশি রয়েছে। পিঁপড়ার পাকস্থলী রয়েছে দুটি। কিছু পিঁপড়া অযৌন প্রজনন ঘটায়। পিঁপড়ার কিছু প্রজাতি রয়েছে, যাদের বংশবিস্তার করতে যৌন প্রজনন প্রয়োজন হয় না। বিশেষ এক ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় এরা বংশবিস্তার করে। নিষিক্ত ডিম নারী পিঁপড়ার দেহে বেড়ে ওঠে আর অনিষিক্ত ডিম পুরুষ পিঁপড়ার দেহে। পিঁপড়ারা সবচেয়ে বড় উপনিবেশ তৈরি করতে পারে। ইতিহাসে পাওয়া যায়, পিঁপড়ার সবচেয়ে বড় সমাবেশ ছিল ৩ হাজার ৬০০ মাইল! এই উপনিবেশ ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনের মতো বড় দেশগুলোর ওপর দিয়েই গেছে। আর এই উপনিবেশ তৈরি করে আর্জেন্টিনার একটি পিঁপড়ার প্রজাতি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই রয়েছে পিঁপড়া। কেবল এন্টার্টিকা ও এ ধরনের কয়েকটি জায়গায় পিঁপড়া নেই। সবচেয়ে বেশি শ্বাস বন্ধ করে রাখতে পারে তারা। মিষ্টি খাবার তাদের পছন্দ।
কোরআনে পিঁপড়ার কথা : কোরআনুল করিমে হজরত সুলাইমান (আ.)-এর আলোচনায় পিঁপড়ার কথা এসেছে। হজরত দাউদ (আ.)-এর ১৯ পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন সুযোগ্য পুত্র। একই সঙ্গে বাদশা ও নবী। তেরো বছর বয়সে রাজকার্য হাতে নিয়ে ৪০ বছর কাল রাজত্ব করেন (মাযহারি, কুরতুবি)। কোরআনে তাঁর সম্পর্কে ৭টি সুরায় ৫১টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি পিপীলিকার ভাষা বুঝতেন। পিঁপড়ার সঙ্গে সুলাইমান (আ.)-এর কথাগুলো আল্লাহতায়ালা অনেক সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন সুরা নমলের ১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯ নং আয়াতে।
বাইবেলে পিঁপড়া প্রসঙ্গ : বাইলে পিঁপড়াদের জ্ঞানী বলা হয়েছে। বাইবেলে আছে, ‘তুমি অলস, তবে পিঁপড়ার কাছে যাও। তার উপায় বিবেচনা কর, জ্ঞানী হও।’ পিঁপড়াদের সাধারণত পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ের উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পিপীলিকাদের মধ্যে একটি রানি পিপীলিকা থাকে কিন্তু এই পিপীলিকার কাজ শুধু ডিম পাড়া। তাই এই রানি পিপীলিকা পুরো পিপীলিকা দলের মা। আরো অনেক বিষয়ে বলা আছে বিভিন্ন অধ্যায়ে (হিতোপদেশ ৬:৬-৮, বাইবেল ৯/১৫)
হাদিসে পিঁপড়া প্রসঙ্গ : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) ও হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর মতো বড় বড় সাহাবি পিঁপড়া সম্পর্কে হাদিস বর্ণনা করেছেন। এই হাদিসগুলোর মধ্যে রসুল (সা.)-কে পিঁপড়া কামড়ানোর হাদিস ও তাদের বাসা জ্বালানো সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। অন্য হাদিসে পিঁপড়াকে না মারার নির্দেশ দেন রসুল (সা.)। সুনান আবু দাউদ ৫১৭৫, ৫১৭৬, ৫১৭৭ ও ৫১৭৮ হাদিসে পিঁপড়া সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
পিঁপড়া খাওয়ার বিধান : আমাদের খাবারে দুধ, চিনি ইত্যাদির সঙ্গে অনেক সময় পিঁপড়া থাকে। দুধ বা চিনির সঙ্গে দু-একটি পিঁপড়াও মুখের ভেতরে চলে যায়। এসব পিঁপড়া খাওয়া বৈধ নয়। কোনো খাদ্যের মধ্যে পিঁপড়া থাকলে তা সম্পূর্ণভাবে বেছে ফেলে দিয়ে ওই খাবার খেতে হবে। জেনেশুনে একটি পিঁপড়াও খাওয়া যাবে না। (আলমুহিতুল বুরহানি ৮/৪১৫, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৮৯, রদ্দুল মুহতার ৬/৩০৬)
পিঁপড়া নিয়ে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার : পিঁপড়া অথবা আখের লাল অংশ খেলে সাঁতার শেখা যায়- এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা। দুই আঙুলে পিঁপড়া ধরে রেখে যে আশা করা হয়, এই আশা পূরণ হয় ইত্যাদি সবধরনের প্রচলিত কথা এগুলো কুসংস্কার। এগুলো বিশ্বাস করা জায়েজ নয়। রসুল (সা.) বলেন, ইসলামে কোনো কুসংস্কার নেই। (মুসলিম)
স্বপ্নে পিঁপড়া দেখলে : এক ব্যক্তি ইমাম জাফর সাদিকের কাছে এসে বলল, আমি পিঁপড়া দেখলাম স্বপ্নে। আমি আর পিঁপড়া কাচের পেয়ালা থেকে খাচ্ছি। ইমাম সাহেব বললেন, তোমার কি স্ত্রী আছে? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাসায় কি কোনো পুরুষ কাজের লোক (দাস) আছে? সে বলল, হ্যাঁ আছে। তিনি বললেন, কাজের লোকটিকে বিদায় করে দাও। তাকে রাখায় তোমার কোনো কল্যাণ নেই। স্ত্রীকে এ কথা বললে স্ত্রী বলল, দাসটি না থাকলে আমাকেও তালাক দিয়ে দাও। (আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া)। সব স্বপ্ন সত্য হয় না। আর স্বপ্নের ব্যাখ্যা হক্কানি আলেমদের থেকে জানা উচিত।
তথ্যসূত্র : হায়ওয়ানাতে কোরআনি, ঘধঃরড়হধষ বেড়মৎধঢ়যরপ, কুরতুবি।