গার্মেন্টের নামে ‘দর্জিগিরি’

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

গার্মেন্টের নামে ‘দর্জিগিরি’

  • মোমিন মেহেদী
  • প্রকাশিত ১৯ মার্চ, ২০১৯

মাটি, পানি ও শ্রম ছাড়া বস্ত্র খাতের সবই আমদানিনির্ভর। কার্যত গার্মেন্টের নামে আমরা ‘দর্জিগিরি’ ছাড়া আর কিছু করছি বলে মনে হয় না। কারণ এ শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ তথা কাঁচামাল উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনে সরকারি তরফে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ কিংবা প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যদিও গার্মেন্ট শিল্পে দেশ অনেক এগিয়েছে বলে দাবি করা হয়। তবে বাস্তবতা হলো, আমদানির তথ্য গোপন করে কাগজ-কলমে বিশাল রফতানির তথ্য দেখিয়ে বাহবা নিচ্ছে, যা সত্যের অপলাপ মাত্র।

বর্তমানে পোশাক খাতের কাঁচামাল আমদানির নির্ভরতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, সোয়েটারে ৯০ শতাংশ, ওভেনে ৮০ শতাংশ এবং নিট খাতে ৩০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঁচামালের এমন আমদানিনির্ভরতার বোঝা মাথায় নিয়ে বস্ত্র খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এখন একমাত্র সরকারই পারে প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ নিয়ে এর সমাধান দিতে। এজন্য কাঁচামাল উৎপাদনে শিল্প উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সাপোর্ট দেওয়া, বন্ডের নামে কালোবাজারে আমদানি করা কাপড় ও সুতার কেনাবেচা একেবারে বন্ধ নিশ্চিত করা, একই সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার পথ বন্ধ করতে সুতা ও কাপড়ের আমদানি নির্ধারিত সময়ের জন্য বন্ধ রাখা অথবা বিশেষ প্রয়োজনে স্থানীয় বাজার থেকে সুতা ও কাপড় কিনতে সিলিং বেঁধে দেওয়া দরকার। এ ছাড়া সিঙ্গেল ডিজিটসহ সহজ শর্তে ঋণ নিশ্চিত করা। সর্বোপরি এ সেক্টরের উদ্যোক্তাদের নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক ডেকে একটি পলিসি নির্ধারণ করাও প্রয়োজন।

তবে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের বক্তব্য বরাবরের মতো আশাবাদী করেছে। তিনি বলেছেন, ওভেন খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে না পারলে ব্যবসা অন্য দেশে চলে যাবে। কারণ বিদেশি ক্রেতারা এখন লিড টাইমকে গুরুত্ব দেন, কম সময়ে পণ্য ডেলিভারি চান। এখনো ৬০-৬৫ শতাংশ ফেব্রিকস চীন-ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় ওভেন খাতে স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আইএফসি (ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন) থেকে কম সুদে ঋণ নিতে সরকার ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করতে পারে। পাশাপাশি ঘন ঘন পরিবর্তন না করে দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রণয়ন এবং এই খাতে প্রণোদনা চালু করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সরকার নিট খাতে প্রণোদনা দেওয়ায় এখন এই খাত কিছুটা এগিয়েছে। এজন্য ওভেনে প্রণোদনা দেওয়া খুবই জরুরি। বর্তমান সরকার ৫-১০ বছরের জন্য ওভেন খাতে আর্থিক প্রণোদনা দিলে বড় বড় অনেক শিল্প গড়ে উঠবে। এতে একদিকে কর্মসংস্থান বাড়বে, অন্যদিকে রফতানিতে মূল্য সংযোজনের পরিমাণও বাড়বে। শিগগির বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়কে লিখিত আকারে জানানো হবে। বর্তমানে সরকারের মন্ত্রিসভায় অনেক ব্যবসায়ী মন্ত্রী আছেন। আশা করছি, তারা পোশাক খাতের বিদ্যমান সঙ্কট বিবেচনায় নিয়ে আশু করণীয় নির্ধারণসহ ভবিষ্যৎ পথনকশা প্রস্তুত করবেন।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সরাসরি গণমাধ্যমকে বলেছেন, দেশীয় শিল্পের এ ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া কারো কাম্য নয়। আমরাও সেটি আশা করি না। বর্তমান সরকার ব্যবসাবান্ধব। ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দেশীয় শিল্পের সুরক্ষায় বিদ্যমান নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংস্কার হতেই পারে। একই সঙ্গে বিদ্যমান নীতি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা ও হয়রানি কমানোর ব্যাপারেও তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। তার এই চেষ্টা খুব দ্রুত এবং দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি বলে মনে করছি। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মতামত হলো, বস্ত্র খাতের বিদ্যমান সমস্যার গভীরে যেতে হবে, যা অনুধাবন করে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি চালু মিলগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে একটি বিশেষ প্যাকেজের আওতায় এনে সর্বাত্মক সহায়তা দিতে হবে। বিদ্যমান মিলগুলোকে স্থায়ী ভিত্তির ওপর দাঁড় না করানো পর্যন্ত আরো নতুন মিলের যাত্রা শুরু করা বাস্তবসম্মত হবে না। এ ছাড়া পাশের দেশ ভারতের সঙ্গে এখানে সুতা ও বস্ত্রকল স্থাপনের পরতে পরতে যে ঘাটতি রয়েছে, সেটি পূরণ করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

দেখার বিষয় হলো, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা কাপড় ফ্যাক্টরিতে না গিয়ে সরাসরি চলে যাচ্ছে কালোবাজারে, যার প্রকাশ্য বড় বাজার রাজধানীর ইসলামপুর। এখানে দেদার বিক্রি হচ্ছে বন্ডের মাধ্যমে এবং চোরাপথে আনা কাপড় ও সুতা। ইসলামপুরে বন্ডের মালামাল বিক্রি এখন ‘ওপেন সিক্রেট’ ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অভিযান চালিয়ে খোলাবাজারে বিক্রির সময় বিপুল পরিমাণ বন্ডের কাপড় হাতেনাতে ধরলেও পরে অজ্ঞাত কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নেওয়া হয়নি। নামমাত্র জরিমানা দিয়ে আবারো ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এই যদি হয় সরকারের সহায়তার নীতি, তাহলে এ খাতের জন্য গড়ে ওঠা দেশীয় মিলগুলো ধ্বংস হতে বেশি সময় লাগবে না। স্থানীয়ভাবে যারা নানারকম ঝুঁকি নিয়ে সুতা ও বস্ত্রশিল্প সম্প্রসারণের চেষ্টা করছেন, তাদের নির্ঘাত ঋণখেলাপির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যারা চাকরি পেয়েছেন, তারাও চাকরি হারাবেন। সরকার মুখে যত কথাই বলুক না কেন, ইসলামপুরের কালোবাজার বন্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বরং সদর-অন্দরের সব পথ খুলে দিয়ে শিল্প উদ্যোক্তাদের অসম প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে বর্তমানে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ অবিক্রীত সুতা ও কাপড় গোডাউনে পড়ে আছে। প্রশ্ন হলো, এই ক্ষতিপূরণ কে দেবে, কোথা থেকে আসবে? আমি যতদূর জানতে পেরেছি, পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে রীতিমতো আতঙ্ক কাজ করছে। শিল্পের প্রধান কাঁচামাল তুলা, মেশিনারিজ এমনকি কারিগরি ও ব্যবস্থাপক পর্যায়ের দক্ষ জনবলও আমদানি করতে হয়। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার লোকজন স্থানীয় গার্মেন্টগুলোর শীর্ষ পদে কাজ করছেন। তার ওপর একদিকে বিদেশি ক্রেতারা পোশাকের দাম কমাচ্ছেন, অন্যদিকে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে।

প্রতি বছর রফতানি আয়ের যে তথ্য প্রকাশ করা হয় তা শুধুই ‘আইওয়াশ’। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করা হয়েছে বলে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) তথ্য প্রকাশ করেছে। কিন্তু এই ৩১ বিলিয়ন ডলার রফতানির পেছনে কত কোটি ডলারের কাঁচামাল (ফেব্রিকস, কেমিক্যাল, মেশিনারিজসহ আনুষঙ্গিক পণ্য) আমদানি করতে হয়েছে তা প্রকাশ করেনি। আমদানি হিসাব বাদ দিলে দেখা যাবে, প্রকৃতপক্ষে তৈরি পোশাক খাতের মূল্য সংযোজন ২০-৩০ শতাংশ হবে এবং সেটিই প্রকৃত রফতানির তথ্য। মোট রফতানি আয়ের বড় অংশ আসে ওভেন খাত থেকে। এ ছাড়া স্থানীয় ফেব্রিকস উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় ফেব্রিকস আমদানি দিনকে দিন বাড়ছে। রফতানি আয়ের বড় অংশই ফেব্রিকস আমদানিতে ব্যয় হয়। এ খাতের ৮০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। অর্থাৎ ওভেন খাতে শুধু ‘দর্জিগিরি’ করে বাংলাদেশ।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে নিট খাতের মতো ওভেন খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য উদ্যোক্তাদের প্রকৃতপক্ষে সিঙ্গেল ডিজিটে ব্যাংক ঋণ দিতে হবে। পাশাপাশি ওভেন ফেব্রিকসে ১০ শতাংশ প্রণোদনা এবং গার্মেন্টগুলোকে স্থানীয় কাপড় ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। তাহলে এ খাতে বিনিয়োগ আরো বাড়বে এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে আমি মনে করি। একই সঙ্গে চীন ও ভারত সবদিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এখনো প্রণোদনা অব্যাহত রেখেছে। অথচ দেশে রফতানির বিপরীতে শুধু ৪ শতাংশ ইনসেনটিভ দেওয়া হয়। তাও পেতে ৩-৪ বছর ফাইলের পেছনে ঘুরতে হয়। বিটিএমএ (বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশন) অবশ্য সেই পুরনো রেকর্ডই বাজিয়েই যাচ্ছে- বর্তমানে স্পিনিং ও ফেব্রিকস মিলগুলো উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে সুতা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। অবস্থা এমনই বেগতিক যে, বেশিরভাগ মিল কর্তৃপক্ষ ঋণের কিস্তি ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না। এ ছাড়া সরকারের দেওয়া ৪ শতাংশ বিকল্প নগদ সহায়তা অন্যান্য দেশের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে সরকারের এই প্রণোদনা শিল্পে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে না।

বাংলাদেশের বস্ত্র বিশ্বময় আলোচিত-মূল্যায়িত বিধায় এই অপার সম্ভাবনাকে ‘সোনালি আঁশ’ পাটের মতো অবিরত ধ্বংস হতে দিতে চাই না। যে কারণে নতুন প্রজন্মের রাজনীতিক হিসেবে বলছি, সমস্যা মোকাবেলায় সম্প্রতি সরকারের কাছে যে ৫ দফা সুপারিশ করেছে বিটিএমএ, সেই দফাগুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি সবার আগে দুর্নীতির মহাদুর্গ ভাঙতে হবে বাংলাদেশের পোশাক খাতকে বাঁচানোর জন্য। আর সেই ৫ দফা হলো- টেক্সটাইল মিলের জন্য কমপক্ষে ১০ বছর পর্যন্ত ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে রাখা, হ্রাসকৃত হারে কর আরোপের মেয়াদ ২০২৮ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা, দেশে তৈরি সুতা ও কাপড়কে ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত পণ্যের তালিকায় রাখা, নগদ সহায়তা ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ শতাংশ নির্ধারণ এবং মিথ্যা ঘোষণায় সুতা আমদানি বন্ধ ও বন্ড সুবিধায় আমদানি করা সুতার ওপর ‘নট ফর সেল’ লিখে সিল মারা।

প্রণোদনা ও ঋণ পলিসিকে সামনের কাতারে আনার সঙ্গে সঙ্গে হাতে হাত রেখে ক্ষয়ে যাওয়া আলোকিত সময়কে ফিরিয়ে আনতে বস্ত্র খাতের জন্য নিবেদিত থাকার গল্প কেবল মুখে নয়, বাস্তবে শিল্প উদ্যোক্তাদের হয়রানি বন্ধ করে সরকারি সহায়তার হাত প্রশস্ত করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকিং সেক্টরের বড় বড় জালিয়াতি-দুর্নীতিবাজ ও ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads