তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে

  • প্রকাশিত ১৯ মার্চ, ২০১৯

দেশ-বিদেশে হাজার হাজার রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে। একটি ঘটনা ঘটলেই নানান মতের-পথের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর জন্ম হয়। এটি ভালো। দেশে একটি ঘটনা ঘটলে আমরা অন্তত কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, আলোচক-সমালোচক খুঁজে পাই। কিন্তু আফসোস, আমরা সবই পারলাম, কিন্তু আত্মসমালোচক হতে পারলাম না। অথচ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলেছেন, আগে নিজেকে জানো। রাজনীতিবিদরা নানামুখী সমালোচনা, সমালোচনায় প্রতিপক্ষকে বাক্যবাণ ছুড়ছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা দিয়ে অন্যকে ব্যর্থ প্রমাণে উঠেপড়ে লেগেছেন। কিন্তু তারা আত্মসমালোচনা করছেন না। সবার মতের ও বিশ্লেষণের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, বাংলাদেশের রাজনীতি কখনো পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের থিওরি দিয়ে চলেনি। বাংলাদেশের গণতন্ত্র অন্য কোনো দেশের গণতন্ত্রের সঙ্গে মেলে না। এত বিশ্লেষণে না গিয়ে শুধু এটুকুই বলি- এদেশে আসলে কোনো কিছুই কোনো পরিকল্পনা করে হয়নি। সেটা ১৯৪৭-এর পর থেকেই নির্মোহভাবে খেয়াল করলে বোঝা যায়। যা ঘটে সাডেন ক্রাউডের মতো। হুট করেই ঘটে। এমনকি অনেক বড় ঘটনাও এভাবেই ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনা আলোকপাত করছি। গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে কত ব্যাখ্যা প্রচলিত ছিল। এই আন্দোলনে ভেতরে ভেতরে অমুক দেশের উসকানি, নেপথ্যে ছিল অমুক। কিন্তু কোনো ঘটনার পেছনে কে বা কারা কেন জড়িত- সেটি স্পষ্ট করে কেউ বলে না। একটা ঘটনা ঘটলে আমরা যেভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করি, তাতে ঘটনাকারী নিজেই অবাক হয়। কারণ তারা ওইসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে ঘটনা ঘটায়নি। ফলে তারা অবাক হলেও মজা পান।

সাম্প্রতিক সময়ে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে নানামুখী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে। ডাকসু নিয়ে অনেকে বলছেন, দেশে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভবের উর্বর ভূমি সৃষ্টি করেছে ডাকসু। ডাকসু নির্বাচনের সঙ্গে তৃতীয় শক্তির উত্থানের সম্পর্ক একদমই অবান্তর। ডাকসু নির্বাচনে নুরুল হকের বিজয় দেশের লাখ লাখ সরকারি চাকরিপ্রত্যাশী যুবকের চাকরি না পাওয়ার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। চাকরিপ্রত্যাশীরা তাদের হতাশা আর বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন ভোটের মাধ্যমে। তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার হচ্ছে, জালভোটের মাধ্যমে ছাত্রলীগও তাদের প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে ক্ষোভের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। জালভোট না হলে ভোটের ব্যবধান আরো বেশি হতো এটাও নিশ্চিতভাবেই বোঝা যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, জনাব নুরকে কিন্তু ভোটগুলো দিয়েছে ছাত্রলীগের একাংশই। কারণ তারাও চাচ্ছেন সরকারি চাকরিটা উন্মুক্ত হোক। ছাত্রলীগের অনেকে তৈলাক্ত ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে খাওয়াতে হয়রান হয়ে যাচ্ছিলেন। তারাও একটু বিশ্রাম চাচ্ছিলেন। আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোটটাও ছিল সরকারি চাকরির নিশ্চয়তার জন্য। সবার কাছেই এখন সরকারি চাকরি সোনার হরিণ। আর এটাকে ধরার জন্যই তাদের জীবনপণ লড়াই। এই নিশ্চয়তা নিশ্চিতের জন্যই প্রতীকী অর্থে সবাই ভোট কিংবা জালভোট দিয়েছেন নুরুকে।

এখন যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের শতকরা ৯৫ জন হলে থাকার সুবিধা ও সরকারি চাকরিতে ছাত্রলীগের সুপারিশ পাওয়ার জন্য ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন। তারা আরো একটু বেশি নিশ্চয়তা চান। এখন বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে এরাও বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতো। বিএনপি হলো আওয়ামী লীগের রাজনীতির ব্যালেন্স অব পাওয়ার। বিএনপিকে জাতীয় রাজনীতিতে সরকার যত দুর্বল করবে, ধীরে ধীরে জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগই তত দুর্বল হবে। আর ভেতরে ভেতরে শক্ত প্রতিপক্ষ কেউ সংগঠিত হতে পারুক বা না পারুক, তাদের উত্থান ঘটবে যে কোনো ঘটনার পরিক্রমায়। হুট করে গণজাগরণ মঞ্চের মতো কিছু একটা হতে পারে। স্কুলের ছাত্রদের মতো কিংবা সবশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হয়েছে, তেমন কিছু একটা হতে পারে। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ করে দিলে অন্তত পানি এত ঘোলা হতো না। নির্বিঘ্নে ছাত্রলীগই সবকিছু রয়েসয়ে খেতে পারত।

মহাভারতে একটি ঘটনার বর্ণনা আছে। রাজা কংস তার রাজজ্যোতিষীর মাধ্যমে জানতে পারেন, তার নববিবাহিত বোন দেবকী এবং তার স্বামী বাসুদেবের ঔরসজাত সন্তানই হবেন তার হত্যাকারী এবং সিংহাসন দখলকারী। কংস এই ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে দেবকী ও বাসুদেবকে কারারুদ্ধ করেন। কিন্তু কারারক্ষীরা দয়াপরবশ হয়ে মাঝে-মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মিলনের ব্যবস্থা করে দিত। ফলে দেবকী গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং কারাগারেই কংসের অজান্তে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম দেন। ভীতসন্ত্রস্ত কারারক্ষীরা শিশু শ্রীকৃষ্ণকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সুদূর গ্রামাঞ্চলের জনৈক গোয়ালের ঘরে রেখে আসে লালন-পালনের জন্য। এভাবে শ্রীকৃষ্ণ যখন গোয়াল-গোয়ালিনীর ঘরে বেড়ে উঠছিলেন, তখন রাজা কংস তাচ্ছিল্যভরে রাজজ্যোতিষীকে জিজ্ঞেস করলেন- কী হে, তোমার ভবিষ্যদ্বাণীর কী হলো? উত্তরে রাজজ্যোতিষী বললেন, ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।’ পরবর্তী ঘটনা কমবেশি সবারই জানা। রাজা কংসের সীমাহীন অত্যাচার, অবিচার, হত্যা, নির্যাতন রাজ্যময় মানুষকে বিক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী করে তোলে। এই বিদ্রোহীরাই যুবক শ্রীকৃষ্ণকে তাদের নেতা মনোনীত করে এবং তার নেতৃত্বে কংসকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।

তাই বাংলাদেশেও হয়তো কোনো ঘরে এমন কেউ জন্মেছে যে হুট করে লাইমলাইটে চলে আসবেন। রাজনীতিতেও অনেক সময় বলের মতো রাজনীতির খেলার মাঠে দলের ভূমিকা গৌণ হতে পারে। বাইরে থেকে এক বল স্টিক দিয়ে ধাক্কা মেরে অন্য বলের সঙ্গে লাগিয়ে বল গর্তে ফেলে দিতে পারে কেউ। তাই আওয়ামী লীগের জন্য এখন বিএনপি ছাড়া উপায় নেই। শক্তিশালী বিএনপিই আওয়ামী লীগকে নিরাপদ ক্ষমতা ও প্রস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। অন্যথায় কী হবে, ভবিষ্যদ্বাণী করা মুশকিল। ঘটনাচক্রে কেউ ডাকসুর নুরুল না হয়ে জাতির নুরুল হয়ে যেতে পারেন।

 

সাগর আনোয়ার

লেখক : জার্মানিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নরত ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads