বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া

সংরক্ষিত ছবি

আইন-আদালত

খালেদার জামিন বিতর্ক, আজ ফের শুনানি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৯ মে, ২০১৮

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাইকোর্টের তর্কিত জামিন আদেশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সরকারের আপিলের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। শুনানি অসমাপ্ত অবস্থায় আজ বুধবার পর্যন্ত আদালত মুলতবি করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন- বিচারপতি মো. ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।

আপিলের শুনানিতে বিএনপি নেত্রীর জামিনের বিরোধিতা করে দুদক ও সরকারপক্ষের যুক্তিতে বলা হয়েছে, হাইকোর্টের দেওয়া জামিন সমর্থনীয় নয়। কারণ খালেদা জিয়া বৈধ যুক্তিতে জামিন আবেদন করেননি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি জনগণের সম্পদের জিম্মাদার হয়েও আত্মসাতের অভিযোগে দণ্ডিত হয়েছেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার আইনজীবী দুদকের মামলায় সরকারের পক্ষভুক্ত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, সরকার এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে মামলাটিতে লড়ছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলাটি প্রভাবিত করতে সরকার পক্ষভুক্ত হয়েছে বলে তারা দাবি করেন।

দুদকের পক্ষে শুনানি করেন খুরশীদ আলম খান, সরকারপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও খালেদা জিয়ার পক্ষে এ জে মোহাম্মদ আলী।

শুনানির শুরুতে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান হাইকোর্টের জামিন দেওয়ার চারটি যুক্তির জবাবে বলেন, খালেদা জিয়াকে বিচারিক আদালত পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। কম সাজার বিবেচনায় দেওয়া জামিন যুক্তিযুক্ত নয়। জামিন অপব্যবহার করেননি বলা হলেও খালেদা জিয়া আদালতের অনুমতি না নিয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন। আর স্বাস্থ্যগত কারণে জামিন দেওয়া হলেও খালেদা জিয়ার পক্ষে চিকিৎসা সনদপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়নি।

এ সময় আদালত দুদকের আইনজীবীকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করেন বয়স ও অসুস্থতা জামিনের কোনো কারণ হতে পারে কি না?

জবাবে খুরশীদ আলম আদালতকে বলেন, দণ্ড হওয়ার পর বয়স জামিনের কারণ হতে পারে না। বয়স বিবেচনায় নিয়েই বিচারিক আদালত খালেদা জিয়ার সাজা কমিয়েছেন। একই কারণ দেখিয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা এখন জামিন চাইছেন।

এরপর লঘুদণ্ড ও জামিন নিয়ে উচ্চ আদালতের একাধিক নজির তুলে ধরে দুদকের আইনজীবী বলেন, খালেদা জিয়া কত দিন কারাগারে ছিলেন, সে বিষয়টি জামিন দেওয়ার সময় নেওয়া হয়নি। খালেদা জিয়ার পক্ষে অসুস্থতার কথা বলা হলেও ব্যক্তিগত চিকিৎসকের মতামতের ভিত্তিতে এমনটি বলা হচ্ছে। তিনি কতটুকু অসুস্থ এটা আদালত কীভাবে বুঝবেন?

তিনি বলেন, রাষ্ট্রের তহবিলে আসা অর্থের জিম্মাদার ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। কিন্তু জিম্মাদার হওয়া সত্ত্বেও তিনি সঠিক জায়গায় অর্থের ব্যবহার না করে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। তার ছেলে তারেক রহমান ও ভাগ্নে মমিনুর রহমানকে টাকা উত্তোলনের সুযোগ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।

এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তি উপস্থাপন শুরু করে বলেন, এ মামলার হাইকোর্টে করা আপিলের শুনানির জন্য পেপারবুক প্রস্তুত হয়ে গেছে। সেখানে আপিলের শুনানি করা যেতে পারে। আপিলে তিনি খালাস পেলে পাবেন। অ্যাটর্নি জেনারেল অভিযোগ করে বলেন, আসামিপক্ষ মামলার বিচারকাজ বিলম্বিত করতে চেয়েছেন। অভিযোগ গঠন করতে লেগেছে ৫ বছর।

এ পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যকে অপ্রাসঙ্গিক বলে উল্লেখ করলে আইনজীবীদের মধ্যে হইচই শুরু হয়। এ অবস্থায় অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এ পরিবেশে শুনানি চলতে পারে না। পরিস্থিতি শান্ত হলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হাইকোর্টের দেওয়া জামিন সমর্থন করা যায় না। কারণ বৈধ যুক্তিতে তিনি জামিন আবেদন করেননি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি জনগণের সম্পদের জিম্মাদার হয়েও সেটা আত্মসাৎ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতাচ্যুত দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন হাইকে দেওয়া ২৪ বছরের সাজা, ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভাকে ১২ বছরের সাজা, জনতা টাওয়ার মামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ৫ বছরের সাজা, ভারতের বিহার রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদবের সাজার তথ্য আদালতে তুলে ধরেন।

খালেদা জিয়ার চলতি কারাজীবন সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যেহেতু তিনি কারাগারে আছেন, বলা যায় তিনি বিশ্রামে আছেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, খালেদা জিয়াকে বয়স ও নারী বিবেচনায় জামিন দেওয়ার যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে সেটা তার জন্য প্রযোজ্য হবে না। শারীরিক অসুস্থতার যুক্তি নতুন কিছু না।

অ্যাটর্নি জেনারেল দাবি করেন ফৌজদারি মামলায় এর চেয়ে স্বচ্ছ বিচার দুনিয়ার কোথাও হয়নি। কথা শেষ না হতেই খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ঘোর আপত্তি জানিয়ে বলেন, এটি দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তিনি এগুলো বলতে পারেন না। এ মামলায় তিনি দাঁড়াতেও পারেন না। তখন আইনজীবীরা জয়নুল আবেদীনের সমর্থনে চিৎকার করে বলতে থাকেন ইয়েস! ইয়েস!

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, তাকে বলতে দিন। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ফৌজদারি মামলায় একজনের বেশি আইনজীবী যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেন না। সেখানে খালেদা জিয়ার পক্ষে পাঁচজন আইনজীবী যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তারা এই মামলা ৯ বছর বিলম্ব করেছেন। আমরা চাই তাড়াতাড়ি আপিলের শুনানি হোক। 

এ সময় খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এখন তো জামিনের শুনানি চলছে। আপিলের শুনানি হচ্ছে না। এ সময় আইনজীবীরা হইচই শুরু করলে এজলাসের পরিবেশ কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

এ পর্যায়ে বিচারপতি মো. ইমান আলী আইনজীবীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানান। জবাবে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, তারা স্বতন্ত্র আইনজীবী।

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, তাকে (অ্যাটর্নি জেনারেল) শেষ করতে দিন। আমরা এভাবে শুনতে পারব না। এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, খালেদা জিয়া জামিন চেয়েছেন। জামিনের প্রয়োজন নেই। তাকে কারাগারে একজন সেবিকা দেওয়া হয়েছে। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসককে কারাগারে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। চাইলে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতেও আমাদের আপত্তি  নেই। সরকার মেডিকেল বোর্ডও গঠন করেছে। চিকিৎসা করতে হলে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে করা সম্ভব।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমরা আপিলের শুনানির জন্য প্রস্তুত। পেপারবুকও তৈরি আছে।

এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী শুনানির সূচনাকালে বলেন, দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। সরকারের এ মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়ার এখতিয়ার নেই। এখানে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই। তার বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রাষ্ট্রের এখতিয়ার আছে।

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বক্তব্য দেবেন না। এরকম হলে শুনানি করা যাবে না।

এরপর মোহাম্মদ আলী বলেন, হাইকোর্ট অতীতে অনেক মামলায় জামিন দিয়েছেন। ভারতেও এমন মামলার অনেক নজির রয়েছে। যেখানে সাজার পর জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টও হাইকোর্টের জামিন আদেশে হস্তক্ষেপ করেননি।

এরপর মোহাম্মদ আলী বলেন, সরকার গোটা বিশ্বকে দেখাতে চাচ্ছে খালেদা জিয়া দুর্নীতিবাজ। কার্যত খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য এটা করা হচ্ছে। এ পর্যায়ে আদালত আজ বুধবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি ঘোষণা করেন।

আদালতে শুনানির সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আবদুল মঈন খান প্রমুখ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads