সম্প্রতি ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের মধ্যে বািবতণ্ডার এক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মিডিয়ার কাটতি বাড়ানোর খোরাকে পরিণত হয়েছে। এদেশের ট্রলবাজ উৎসুক জনতারও একটা খোরাক হয়ে উঠেছে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, উভয় পেশার মানুষজনই তাদের পেশার ‘কোড অব প্রফেশন ও কোড অব কন্ডাক্ট’ পলিসির বাইরে গিয়ে আপন ক্ষমতার দম্ভ ব্যবহারের আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, ক্ষমতার দম্ভ তথা পাওয়ার প্র্যাকটিস যদিও এখানকার নিত্য ঘটনা। এখানে সবাই পাওয়ার প্র্যাকটিস করতে চায় এবং করতেই অভ্যস্ত। যার পাওয়ার প্র্যাকটিসের অধিকার নেই, সেও এখানে সেই পাওয়ার প্র্যাকটিসের অধিকার তৈরি করে নিতে পারে।
আমি অমুক, আমি তমুক, তোকে দেখে নেব—এগুলো এদেশের মানুষের মুখের বুলি। দর্শনের ভাষায়, একটা জাতি কেমন তা জানার অন্যতম মানদণ্ড হলো সেই জাতির মানুষের আচার-আচরণ কেমন, অন্যদের সঙ্গে সে কেমন আচরণ করে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, ডাক্তার ভদ্র মহিলাটি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশকে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তুই-তুকারি শুরু করেন এবং সে অমুক-তমুক, অমুক-তমুকের মেয়ে বলে নিজের ক্ষমতার জাহির করতে থাকেন। একপর্যায়ে সহ্য ক্ষমতাকে বলি দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশও স্বাধীনতাযুদ্ধে নিজেদের পূর্বসূরিদের ভূমিকা তুলতে থাকেন।
এখানে ডাক্তার ভদ্র মহিলাটি, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের মধ্যে বািবতণ্ডার সূত্রপাত মূলত মুভমেন্ট পাস নিয়ে। ডাক্তারদের মুভমেন্ট পাসের প্রয়োজন নেই তথা তারা মুভমেন্ট পাস ছাড়াই চলাচল করতে পারবে। কিন্তু একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার ক্ষমতাবলে চাইলে যে-কোনো সময় যে কাউকেই তলব করতে পারে। রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ অভিযানে ওই ডাক্তার মহিলাটির সঙ্গেও তেমনি ঘটেছে এবং এটা ম্যাজিস্ট্রেটের পেশাগত দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। তিনি ডাক্তার ঠিক আছে, তাই তার মুভমেন্ট পাসের দরকার নেই। কিন্তু তিনি যে একজন ডাক্তার সে পরিচয়ের নিশ্চয়তাও তো দরকার আছে। ডাক্তারি পোশাক পরিধান করলেই তো সবাই আর ডাক্তার হয়ে যান না, মুখোশধারীও তো থাকতে পারে। যেমনটা সচরাচর দেখা যায়। অ্যাম্বুলেন্সে সবসময় রোগী বহন করে না, অনেক সময় ভালো মানুষ এবং অনেক সময় সন্ত্রাসীও বহন করে। যেগুলো আমাদের সবারই জানা। এক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার দায়িত্ব পালনের সঠিক অবস্থানে ছিলেন।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যখন ওই ডাক্তারকে তার আইডি কার্ড প্রদর্শনের জন্য বললেন, তখন তিনি আইডি কার্ড প্রদর্শনের বদৌলতে পেশাগত আচরণ ভঙ্গ করে তুই-তুকারি শুরু করে নিজের পাওয়ার প্র্যাকটিস করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। তিনি দাপট দেখিয়ে বলেন—তিনি বীরবিক্রমের মেয়ে। তিনি অমুক-তমুক, এই-সেই। এখন আলোচনার বিষয় হলো—তিনি বীরবিক্রম মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে এই পদবির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ নিয়ম বা আইনের কী যোগসাজশ? তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হোন না কেন—আইন তো আইন। আইনের দৃষ্টিতে তো সবাই সমান।
কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ওই ডাক্তার মহিলা পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের যোগ্যতা, পদ-পদবিকে হেয় প্রতিপন্ন করেন। তিনি ম্যাজিস্ট্রেটকে কটাক্ষ করে বলেন—‘তুই মেডিকেলে চান্স পাস নাই বলে তুই ম্যাজিস্ট্রেট, আমি চান্স পাইছি বলেই আমি ডাক্তার।’ একজন প্রকৃত জ্ঞানী মানুষ, দায়িত্বশীল পেশাদার মানুষ কখনোই এমন অসৌজন্যমূলক ঔদ্ধত্য আচরণ করতে পারেন না, নিজের পেশাকে সম্মানের চূড়ায় উঠিয়ে অন্যের পেশাকে অপমান করতে পারেন না। রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ নিয়ম ভঙ্গার্থে পেশাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন না। একজন ডাক্তার তার ডাক্তার হয়ে ওঠার পেছনে যে পরিমাণ মেধা-শ্রম দিয়েছেন এবং ডাক্তার হয়ে উঠেছেন, ঠিক তেমনি একজন ম্যাজিস্ট্রেট, একজন পুলিশ এবং অন্য পেশার মানুষজনও কিন্তু সে পরিমাণ মেধা-শ্রম দিয়েছেন নিজের পেশাকে প্রতিষ্ঠিত করতে।
সমাজে সব ধরনের পেশারই সমান মূল্য ও মর্যাদা রয়েছে। আমরা প্রত্যেক পেশার মানুষজনই একে অন্যের ওপর সমানভাবে নির্ভরশীল। ডাক্তার ছাড়াও যেমন আমাদের চলা সম্ভব না, পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও আমাদের চলা সম্ভব না। তেমনি সমাজের প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষই আমাদের কাছে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ বিনির্মাণে কারো অবদান কোনো অংশে কম নয়। একজন রিকশাচালক, একজন দিনমজুরও কিন্তু সমাজ বিনির্মাণ ও আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে সুন্দর করার পেছনে কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছেন।
ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের সেই বািবতণ্ডায় দেখা যায়, ডাক্তার মহিলাটি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে হামকি-ধমকি দিয়ে কথা বলছেন। অথচ ডাক্তার মহিলাকে আইডি কার্ড প্রদর্শনের জন্য বলা হলে উনি টেনে আনছেন করোনাকে। সর্বদিকে করোনাকে পুঁজি করার যে দৃশ্য তা বুঝি এখানেও দেখার বাকি ছিল! করোনা মহামারীর জাতীয় এই দুঃসময়ে যেখানে উচিত সব পেশার সব ধরনের মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণে করোনাকে প্রতিহত করা, সেখানে করোনা নিয়ে হচ্ছে পেশাভিত্তিক উপহাস, হচ্ছে রাজনীতি।
ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের মধ্যে বািবতণ্ডার ঘটনাটি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতো না যদি ওই মহিলা ডাক্তারটি ‘সিন ক্রিয়েট’ না করতেন, পাওয়ার প্র্যাকটিস প্রদর্শনের চেষ্টা না করতেন। উনি বািবতণ্ডা না করে চাইলেই বিনয় ও নম্রতা প্রদর্শন করে বিষয়টি বুঝিয়ে সুন্দরভাবে চলে যেতে পারতেন। অথচ নিজেকে পরিচয় দিলেন অপেশাদার, দায়িত্বহীন ও কাণ্ডজ্ঞানহীন একজন মানুষ হিসেবে। তিনি যে আচরণ প্রদর্শন করেছেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে তার নির্বাহী ক্ষমতাবলে তার নামে মামলা দায়ের করতে পারতেন, তাকে দণ্ডাজ্ঞা দিতে পারতেন। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এ ঘটনা ঘটলে এমন ব্যবস্থাই নেওয়া হতো।
আইনের সর্বোৎকৃষ্ট গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন অধ্যাপক ডাইসি। তিনি বলেছেন, ‘আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান।’ বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে—‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান।’ কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইনের এ সংজ্ঞার উল্টো চিত্রটাই লক্ষ করা যায়। এখানে আইনকে সবাই সমান চোখে দেখতে চায় না বা আইনকে যথাযথভাবে মান্য করতে চায় না। আইনের চোখে সবাই সমান বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে কি সবাই সমান? এখানে দেখা যায়, ক্ষমতাবানরা আইন মান্য করেন না এবং তারা আইনের শাস্তি থেকে বিরতও থাকেন। মাঝখান দিয়ে আইনের ফাঁকফোকরের শিকার হন ক্ষমতাহীন সাধারণ জনগণ।
মানুষ আইন মান্য করে তখন-যখন তার শাস্তির ভয় থাকে। কিন্তু এখানকার মানুষের মনে একটা বিষয় গেঁথে গেছে, আইন ভঙ্গ করে পার যাওয়া যায়। কেননা সে জানে, তার পেছনে ক্ষমতার একটা ছায়া আছে যা দিয়ে সে অপরাধ করলেও আইন ভঙ্গ করেও পার পেয়ে যেতে পারবে। মূলত এই প্রবণতা থেকে বেড়ে চলেছে অপরাধ, ব্যাহত হচ্ছে আইনের শাসন। আমাদের এখনই সময় এর লাগাম টেনে ধরার। ‘আইন সবার জন্য সমান’—এ মতবাদের সঠিক বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। আর এ বাস্তবায়ন সম্ভব হলেই আইনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, আইনের প্রতি মানুষ শ্রদ্ধাশীল হবে। একটি দেশ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে তখন যখন সেই দেশে আইনের শাসন থাকবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সে দেশের জনগণ সুনাগরিক হবে। তাই আইনের শাসনের যথাযথ প্রতিষ্ঠা যেমন সরকারের দায়িত্ব, তেমনি সুনাগরিক হিসেবে আইন মান্য করাও দেশের প্রতিটি মানুষের কর্তব্য।
লেখক : ইমরান ইমন
সাংবাদিক