একসময় ক্রিকেট ব্যাট আমদানি করতে হতো। সেদিন বদলে গেছে অনেক আগেই। গত এক দশকে আমদানির চিত্র পাল্টে দিয়েছে যশোরের নরেন্দ্রপুর এবং পিরোজপুরের বিন্না গ্রামের বাসিন্দারা। এরপর থেকে ক্রিকেট শুধুই খেলা নয়- আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। ক্রিকেট ব্যাট তৈরির এই তৎপরতা কীভাবে অর্থনীতির চাকায় গতিময় হলো, তেমন কিছু গল্প নিয়েই এই প্রতিবেদনটি সাজিয়েছেন- এস এম মুকুল
পথ দেখালো নিলুফার ইয়াসমিন
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুর জেলার নাসিরাবাদ উপজেলার বিন্না গ্রামের বাসিন্দা নিলুফার ইয়াসমিনের ঢাকার জুরাইনে ক্রীড়াসামগ্রী বিক্রেতা স্বামীর উপার্জনে সংসার চালাতে কষ্ট হতো। টানাপড়েনের জীবন-সংসারে ভবিষ্যতের অনিশ্চিত যাত্রা ভাবিয়ে তুলল তাকে। পরিবারের দৈনদশা কাটাতে কিছু একটা করতেই হবে এমন মানসিক শক্তি তার স্বামীর পেশার ধারাবাহিকতায় স্বাবলম্বনের পথে আশার আলো জাগায়। সিদ্ধান্তমতো নিলুফার ইয়াসমিন কাজ শুরু করেন। ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করে বিক্রির ব্যবস্থা করলেন স্বামীর সহযোগিতায়। এই শুরু তো শুরু। উদ্যোগ গ্রহণের পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বিন্না গ্রামে নিলুফারের কারখানায় এখন অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান। একজন গ্রামীণ মহিলার সৃজনশীল উদ্যোগ বৈপ্লবিক পটপরিবর্তনের শুভ সূচনা হয় বিন্না গ্রামে। মাসে হাজার হাজার ব্যাট তৈরি হয় কোম্পানিতে। নিলুফারের সাফল্য দেখে তাকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করে গ্রামেই গড়ে ওঠে ছোট-বড় আরো প্রতিষ্ঠান। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে প্রায় হাজার লোকের। নিলুফার ইয়াসমিনের এ উদ্যোগ চোখ খুলে দেয় এলাকাবাসীর। সবার চোখে-মুখে স্বাবলম্বনের স্বপ্ন এঁকে দেন তিনি। কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে স্বপ্ন-সাফল্যের পথযাত্রী নিলুফার ইয়াসমিন কানাডার পূর্ব উপকূলে আটলান্টিক তীরবর্তী বরফঢাকা শহর হ্যালিফ্যাক্স থেকে সিটি গ্রুপ ফাউন্ডেশন আয়োজিত শ্রেষ্ঠ সৃজনশীল উদ্যোক্তা পুরস্কার-২০০৬ অর্জন করেন। ২০০৭ সালে কানাডার হ্যালিফ্যাক্সে ক্ষুদ্রঋণ ও ক্ষুদ্রশিল্প উদ্যোক্তাবিষয়ক সম্মেলনে নোবেলবিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে নিলুফার ইয়াসমিনও প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন, যার অর্থমূল্য হিসেবে তিনি পান ৪ হাজার মার্কিন ডলার।
নেসারাবাদের বিন্না গ্রামে শুরু
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, স্বরূপকাঠি অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটব্যাট তৈরির শতাধিক কারখানাসহ সারা দেশের আরো সমসংখ্যক অনুরূপ কারখানার পথিকৃৎ ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ মো. আবদুল লতিফ। ১৯৮৮ সালে উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের বিন্না গ্রামের মো. আবদুল লতিফ সর্বপ্রথম তার বাড়িতে এ ক্রিকেটব্যাট তৈরির কারখানা গড়ে তুলে এ শিল্পের গোড়াপত্তন করেন। ক্রিকেট খেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় ক্রিকেটব্যাটের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পায়। ফলে উপজেলার গগন, উড়িবুনিয়া, জিলবাড়ি, বিন্না, চামীসহ বিভিন্ন গ্রামে গড়ে ওঠে প্রায় দেড় শতাধিক ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কারখানা। এখানকার তৈরি করা ক্রিকেট ব্যাট ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চালান হয়। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকা। এসব কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে কিশোর, তরুণ ও বাড়ির মহিলারা। প্রায় সব পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই ব্যাট তৈরি করাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। ব্যাট তৈরিতে ব্যবহূত হয় আমড়া, কদম, ডুমুর আর ছাতিয়ানের মতো সহজলভ্য কাঠ। সাতটি সাইজে বিভিন্ন স্তরে তৈরি হয় এ ক্রিকেট ব্যাট। প্রথমে স’মিলে সাইজমতো গাছ কেটে ব্যাটের মূল অংশটি তৈরি করা হয়। আর তিনটি অংশ একত্র করে তৈরি হয় ব্যাটের হাতল। পরে মূল অংশের ত্রিকোনাকৃতির মাঝে হাতল দিয়ে ব্যাট তৈরি করা হয়। স্থানীয়দের অভিমত, ব্যবস্থাপনার অভাবে সুন্দরভাবে বিকশিত হচ্ছে না সম্ভাবনার এ শিল্পটি। এ শিল্পের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখান থেকেই তৈরি হবে বিশ্বমানের ক্রিকেট ব্যাট। নেসারাবাদ উপজেলা সদর থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বেলুয়া নদীর পূর্বপাড়ে বিন্না গ্রামের অবস্থান। অবাক হওয়ার কিছুই নেই- এমন অজপাড়াগাঁয়ে আধুনিক জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটের ব্যাট তৈরি হচ্ছে প্রায় ৩০ বছর ধরে। এখানে ব্যাটের কারখানা গড়ে ওঠার বিশেষত্ব হলো, এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ কাঠের বাজার এ উপজেলায়ই অবস্থিত। প্রচুর গাছগাছালি, কাঠের সহজলভ্যতা এবং শ্রম সস্তা হওয়ায় এ উপজেলায় ব্যাট তৈরির কারখানার ব্যাপক প্রসার ঘটে। নেসারাবাদের তৈরি ব্যাট মানসম্মত ও কিছুটা সস্তা হওয়ায় দেশজুড়ে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে এখান থেকে ব্যাট কিনে নেন প্রয়োজনমতো।
ক্রিকেটব্যাটের গ্রাম নরেন্দ্রপুর নাম
পাঠকদের এবার জানাব ক্রিকেট ব্যাট তৈরির আরেকটি গ্রামের গল্প। ব্যাটের গুরু যশোর সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামের কাঠমিস্ত্রি সঞ্জিত মজুমদার। ১৯৮৮ সালে একটি ক্রিকেটব্যাট নিয়ে গ্রামে আসেন। করাত আর বাটালি নিয়ে তৈরি করে ফেলেন সুন্দর একটি ক্রিকেটব্যাট। নরেন্দ্রপুর গ্রামে ক্রিকেট ব্যাটের যাত্রা শুরু হয় এখান থেকেই। পরে সঞ্জিত তার স্ত্রী, দুই ছেলেকে নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমান। তবে ব্যাটের সূতিকাগার যশোর সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর ইউনিয়নের নরেন্দ্রপুর মিস্ত্রিপাড়ার নামটি ক্রিকেটব্যাট তৈরির জন্য সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে। অর্ধশতাধিক কারখানায় হাজার হাজার ব্যাট তৈরি হয় এখানে। সেই ব্যাট পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। ব্যাট তৈরির কারখানায় ছয় শতাধিক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান। নরেন্দ্রপুরের তৈরি ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে পেশাদার বা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা না হলেও এসব ব্যাট দিয়ে ক্রিকেট খেলা হয় গ্রামগঞ্জে, শহরের অলিগলিতে, মাঠ-ময়দানে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা যশোরের মূল শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে নরেন্দ্রপুর গ্রাম। গ্রামটি মিস্ত্রিপাড়া নামেও পরিচিত। তবে খেলার উপকরণ প্রস্তুত করার সুবাদে নরেন্দ্রপুর এখন ক্রিকেট ব্যাটের গ্রাম হিসেবে অধিক পরিচিত। বছরের পর বছর তারা আপন মনে নিপুণভাবে তৈরি করছেন খেলার এ সামগ্রীটি। অভ্যন্তরীণ বাজারে তাদের তৈরি ব্যাট পাওয়া যাচ্ছে বলেই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। মিস্ত্রিপাড়ার একেকটি ঘর যেন একেকটি ক্রিকেটব্যাট তৈরির কারখানা। জানা গেছে, বাংলাদেশ কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে জিতলেই ক্রিকেটব্যাটের বিক্রি বেড়ে যায়। নরেন্দ্রপুরে ব্যাট তৈরির ৫০-৬০টি কারখানা রয়েছে। এখানে ছয়-সাতশ’ মানুষ কাজ করে। পুরুষরা ব্যাট তৈরি করে। রঙ ও স্টিকার লাগানোর কাজ করে মহিলারা। প্রতিটি কারখানায় মাসে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার ব্যাট তৈরি হয়। এসব ব্যাট পাইকারি বিক্রি হয় ৫০ থেকে ২২০ টাকায়। এখান থেকে প্রতি শীত মৌসুমে সারা দেশে তারা সরবরাহ করেন লাখের অধিক ক্রিকেট ব্যাট। সে গ্রামের অনেকে ব্যাট বানিয়ে বিক্রি করে সংসারের হাল ফিরিয়েছেন। নরেন্দ্রপুরের ব্যাট এখন শুধু শহরে নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে। আর টাইগাররা কোনো ম্যাচ জিতলে তো কথাই নেই। এক ধাক্কায় বেড়ে যায় ব্যাটের চাহিদা। বিভিন্ন তথ্যবিশ্লেষণে জানা যায়, এ গ্রামে প্রথম ব্যাট তৈরি শুরু করেন সঞ্জিত মজুমদার। ২০ বছর আগে নিজের বাড়িতে ব্যাট তৈরি করে বিক্রি শুরু করেন। খুলনার ক্রীড়াসামগ্রী ব্যবসায়ীরা তাকে এ ব্যাট তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করেন। চাহিদা বাড়লে নরেন্দ্রপুর মিস্ত্রিপাড়ার কারিগররা ঝুঁকে পড়েন এ ব্যবসায়। স্থানীয় ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের মতে, এখানকার বড় সমস্যা বিদ্যুৎ। চলাচলের জন্য উন্নত রাস্তা প্রয়োজন। মৌসুমে শীতকালে মিস্ত্রিরা কাজ করেন দিন-রাত। অফ সিজনে স্বাভাবিক বাজার ধরে রাখতে কাজ করেন এবং পরের সিজনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠ সাইজ করে প্রস্তুতি রাখেন। ব্যাট কারিগরদের মতে, সরকারি সহযোগিতা, বিদ্যুৎ সুবিধা, ব্যাংকঋণ ও বাজারজাত করার সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে এই ব্যাট তৈরি শিল্পটি একটি বড় শিল্পে পরিণত হওয়ার সুযোগ আছে।
রূপসার নেহালপুর
খুলনার সবচেয়ে কাছের উপজেলা রূপসার নৈহাটি ইউনিয়নের নেহালপুর গ্রামের যুবকদের প্রচেষ্টায় তৈরি ক্রিকেটসামগ্রী শোভা পাচ্ছে দেশের স্পোর্টস মার্কেটের অভিজাত বিপণি বিতানগুলোয়। ব্যাটসহ অন্যান্য কুটির শিল্পকর্ম তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষত্বের কারণে গ্রামটিকে ‘মিস্ত্রিপাড়া’ বলেও অনেকে চেনেন। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই গ্রামে গড়ে উঠেছে ক্রিকেটের ব্যাট, স্টাম্প তৈরির কারখানা। আমড়া, কদম, ছাতিয়ান (ছাইতেন), পাহাড়ি নিম এবং পুয়ে গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ক্রিকেটব্যাট এবং শিশু, ইপিল ইপিল এবং মেহগনি গাছের কাঠে ব্যাটের হাতল, স্টাম্প ও বেল তৈরি হচ্ছে।
ক্রিকেট এখন বিশ্বমাত করা খেলা। ক্রিকেটে বাংলাদেশের ধারাবাহিক জয়জয়কার বিশ্বকে নতুনভাবে জানান দিচ্ছে বাংলাদেশ। এই খেলার অন্যতম অনুষঙ্গ ব্যাট। সরকারের সুনজরে এই ব্যাটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দেশের এসব শিল্প আশার সঞ্চার করবে এতে সন্দেহ নেই। এই শিল্পের সম্ভাবনা ছড়িয়ে পড়ুক দেশ থেকে দেশান্তরে। জয় হোক বাংলাদেশের। এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।
লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও কলাম লেখক