কৃষি ভর্তুকি বাড়ানো হোক

কৃষির সমৃদ্ধি ব্যতীত সমৃদ্ধ অর্থনীতি অর্জন করা সম্ভব নয়

আর্ট : রাকিব

ফিচার

কৃষি ভর্তুকি বাড়ানো হোক

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ২৭ জুন, ২০১৮

কৃষিই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। কৃষির সমৃদ্ধি ব্যতীত সমৃদ্ধ অর্থনীতি অর্জন করা সম্ভব নয়। সঙ্গত কারণেই কৃষির উন্নয়নে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা উচিত। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট ঘোষিত হয়েছে। বাজেটের ওপর জাতীয় সংসদে আলোচনাও চলছে। আলোচনা শেষে ঘোষিত বাজেট পাস হবে। আমরা আমজনতা। তবুও বাজেটে কৃষি ভর্তুকির বিষয়ে দু’চারটি কথা বলা প্রয়োজন বলে মনে করছি।

গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯১ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যেই অর্থমন্ত্রী পাঁচবার জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছেন। কম-বেশি প্রতিবছরই বাজেটের আকার বেড়েছে, কিন্তু কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকার ঘরেই দাঁড়িয়ে আছে। সর্বশেষ অর্থমন্ত্রী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন। এটি সর্বকালের সর্ববৃহৎ জাতীয় বাজেট। এ অর্থবছরে যে পরিমাণ অর্থ জাতীয় বাজেটে ঘোষিত হয়েছে, তা গত ২০১২-১৩ অর্থবছরের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু এ বছরও কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকার ঘরেই বাক্সবন্দি অবস্থায় আছে। আমরা জানি, সরকার সার, ডিজেল, বিদ্যুৎ, বীজ ও কৃষকদের অনুকূলে কৃষি ভর্তুকির টাকা খরচ করে থাকে। গত ৬ বছরে সার, ডিজেল, কৃষি উপকরণ ও বীজের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তুলনা করলে জাতীয় বাজেটের আকার বৃদ্ধির কারণে কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকার দ্বিগুণ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কৃষিপ্রধান দেশের কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কেন বাড়ে না, তা আমাদের বোধগম্যের বাইরে। তবে আমরা মনে করি, যেহেতু জলবায়ুজনিত অভিঘাত অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, আগাম বন্যার কারণে কৃষি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; সেহেতু কৃষি উৎপাদন ও কৃষকের বৃহত্তর স্বার্থে কৃষিতে ভর্তুকি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আবার গোটা বিশ্বে উষ্ণায়ন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের উষ্ণতা এখন অনেক বেশি প্রবল। নদ-নদীগুলো নাব্য হারিয়ে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এমন পরিস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবেলায় দায়ী উন্নত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণের অর্থও যেমন ঠিকঠাক মতো পাওয়া যাচ্ছে না, আবার যৎসামান্য যা পাওয়া যায়, তাও যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। সব মিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোর মুখের দিকে চেয়ে না থেকে আমাদের জাতীয় বাজেটে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি করে তা মোকাবেলা করা উচিত।

স্মরণে রাখতে হবে, আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় মাপের চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এ দেশের কৃষকের নিরন্তর প্রচেষ্টার অন্ত নেই। কৃষিতে অনেক সাফল্য এসেছে। খাদ্যশস্য, সবজি উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। ফলে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমলেও সীমিত জমিতে চাষাবাদ করে ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দিয়ে যাচ্ছে এ দেশের কৃষককুল। কিন্তু কৃষিতে সাফল্য এলেও কৃষকের অবস্থা ভালো নেই। একদিকে আবহাওয়াজনিত দুর্যোগে চাষিদের ফসল নষ্ট হয়, অন্যদিকে কষ্ট করে চাষাবাদ করলেও চাষিরা অধিকাংশ সময়েই উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না। ফলে ধারদেনা, ব্যাংকঋণ, মহাজনী ঋণও চাষিরা পরিশোধ করতে পারেন না। ফলে তারা দেনাদার হয়ে যান। এক পর্যায়ে তারা চাষের জমি বিত্তশালীদের নিকট বিক্রি করতে বাধ্য হন। এভাবে অনেক কৃষক স্বাধীনতা-উত্তর গত ৪৭ বছরে চাষের জমি হারিয়ে হয়েছেন বর্গাচাষি কিংবা ভূমিহীন। ফলে তারা জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে নগর-মহানগরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এ অবস্থা দিনে দিনে আরো প্রবল হচ্ছে। মূলত এর পেছনে যে কারণগুলো অন্যতম, সেদিকে সংশ্লিষ্টজনদের নজর দেওয়া জরুরি।

উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণনে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা থাকা জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশের চাষিরা উৎপাদন শেষে ক্ষমতাসীনদের কাছে পানির দামে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হন। এমনকি সবজিতে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করলেও অধিকাংশ সময়ে সংরক্ষণের অভাবে সবজির ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন কৃষক। এর ফলে অনেক সময়ে জমিতেই সবজি নষ্ট হয়ে যায়। আবার ধান, গম, ভুট্টা, আলুর বাড়তি ফলন হলেই কৃষকের কপাল পোড়ে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জাতীয় বাজেটে প্রতিবছর থোক বরাদ্দ রেখে সরকারিভাবে সবজি সংরক্ষণ উপযোগী হিমাগার নির্মাণ করতে হবে। যেন চাষিরা সবজি উৎপাদন করে স্বল্প ভাড়ায় হিমাগারে রেখে সারা বছর বিপণন করতে পারে। তাহলে দেশীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশে সবজি রফতানি করাও সম্ভব হবে। আবার দেশে যে হারে চরাঞ্চলে দো-আঁশ মাটিতে ভুট্টার চাষাবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে দিকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিলে পোল্ট্রি শিল্পের অন্যতম খাবার ভুট্টা চাষে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনাও সম্ভব। এ জন্য সরকারকে ধান, চাল, গমের ন্যায় অভ্যন্তরীণভাবে ভুট্টা সংগ্রহ করা উচিত। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সবকিছু বোঝার পরও কেন কৃষকবান্ধব খাদ্য নীতিমালা গ্রহণ করে না, তা বোধগম্য নয়। সুতরাং কৃষিতে আরো সমৃদ্ধি আনতে হলে উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণনের ক্ষেত্রে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। তাহলে কৃষিতে অমিত সম্ভাবনার যে দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, তা আরো বিকশিত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

মোদ্দাকথা, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি করতে হলে জাতীয় বাজেটে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। চলতি বাজেট অধিবেশনে কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি করে কৃষি খাতের সমৃদ্ধি অর্জনে সরকার যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে- এটাই দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা।

লেখক : সমাজকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads