কৃষি বহুমুখীকরণে অগ্রগামী বাংলাদেশ

সংগৃহীত ছবি

কৃষি অর্থনীতি

কৃষি বহুমুখীকরণে অগ্রগামী বাংলাদেশ

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ৭ অক্টোবর, ২০২০

কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশ দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে প্রকৃতি ও জনসংখ্যার সাথে সমন্বয় রাখতে যুদ্ধ করে এগিয়ে চলেছে।  স্বাধীনতার আগে যেখানে সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন চাহিদায় হিমশিম খেতে হতো, কালপরিক্রমায় স্বাধীনতার চার দশক পর ষোল কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মিটানো সংগ্রামে নিয়োজিত বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা। সময়ের বিবর্তনে এসেছে নতুন নতুন ফসল, প্রসারিত হচ্ছে নব নব প্রযুক্তি। ১৯৭০ সালে দেশে চাল উৎপাদন হতো প্রায় এক কোটি টনের মতো। কৃষিকে বহুমুখীকরণে বাংলাদেশ এখন অনেক অগ্রগামী। কৃষি সেক্টরে ধান, পাটের পাশাপাশি মৎস্য ও পশু পালন, দুগ্ধ উৎপাদন, হাঁস-মুরগি পালন, নার্সারি, বনায়ন এবং কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটছে বাংলাদেশে। কাজেই কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য কৃষকের কথা বলতে হবে। কৃষকের কথা শুনতে হবে। কৃষক বাঁচলে কৃষি বাঁচবে। কৃষি বাঁচলে দেশ বাঁচবে।

কৃষকের জ্ঞানকে স্বীকৃতি দিতে হবে : কৃষি আমাদের সমৃদ্ধির অন্যতম উৎস। এই কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন গ্রাম বাংলার কৃষক। বন্যা, খরা কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই দমাতে পারেনি বাংলার কৃষকদের। নিঃস্ব, শূন্য অবস্থান থেকেও বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলার কৃষক। ফলিয়েছে সোনার ফসল। কৃষকরা প্রকৃতি ও স্বভাবগতভাবে উদ্ভাবক, সৃজনীক্ষমতার অধিকারী ও প্রকৃতি বিজ্ঞানী।  গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার তাত্ত্বিক সূত্র না জানলেও নিবিষ্ট চিন্তা-চর্চা ও প্রকৃতির গতিবিধির সাথে সখ্যতার খেলায় উদ্ভাবন করেন নতুন পদ্ধতি-প্রক্রিয়া। প্রাকৃতিক চর্চায় নতুন জাতের ‘হরি ধান’ উদ্ভাবন করে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন কৃষক হরিপদ কাপালি। তিনি পেয়েছেন চ্যানেল আইয়ের স্বীকৃতি— কৃষি পদক। আবার অনেক  কৃষক নিবিষ্ট মনে কাজ করে যাচ্ছেন। উদ্ভাবন করছেন নতুন নতুন জাতের ফসল এবং কৃষিবান্ধব প্রযুক্তি। যশোর অঞ্চলের আফাজ পাগলার ঔষধি গ্রাম, কার্তিক প্রামাণিক কিংবা আজিজ কোম্পানির বৃক্ষপ্রেম এখন বৈপ্লবিক দৃষ্টান্ত। চ্যানেল আইয়ের কৃষি পদক এ ধরনের উদ্যোগের অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও বটে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃষকদের স্বীকৃতি দিতে হবে। কৃষি গবেষকদের সাথে কৃষকের যোগসূত্র তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।

কৃষক ও প্রযুক্তি-প্রজন্মের মেলবন্ধন : এখন অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগ। চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ সুবিধাসহ তথ্য কেন্দ্র স্থাপনের ফলে কৃষকরা অনলাইনের মাধ্যমে পণ্য বিক্রিতে ছয় গুণ বেশি লাভ করতে পারছে। অবাধ তথ্যপ্রবাহের এ সুযোগটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে সম্ভব। এরফলে কৃষক ন্যায্যমূল্যের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়েও সমৃদ্ধ ও সচেতন হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটলে তরুণরাও হয়ে উঠবে কর্মোদ্দীপক। ২— ৫ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে মেধা, শ্রম, পুঁজি ও সময় খাটিয়ে যতটুকু লাভবান হবে-তারচেয়ে বহুগুণে দেশের মাটিতে কম টাকা বিনিয়োগ করে গ্রামীণ এলাকা থেকেও বিপুল আয় করা সম্ভব।

রবীন্দ্রনাথের কৃষি ভাবনা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন, গ্রামের উন্নতির মধ্যেই সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভরশীল। কেননা, আমাদের শহুরে জীবনের  উপভোগ্য অধিকাংশই গ্রাম থেকে আসে। তাহলে গ্রামের কৃষকদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারলেই সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়ন ঘটবে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য কৃষিকে বহুমুখী করার বিকল্প নেই। তাই তিনি কী করে কৃষককে আত্মশক্তিতে বলিয়ান করা যায়, উৎপাদন বাড়াতে কীভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যায়, কৃষকের সন্তানকে কী করে শিক্ষা দেওয়া যায় —এসব নিয়ে ভেবেছেন এবং কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নোবেল পুরস্কারের ১০ লাখ ৮০ হাজার  জমা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন কৃষি ব্যাংক। কৃষির উন্নয়নে তিনি নিজের সন্তান, জামাতা এবং বন্ধুপুত্রকে অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজে না পাঠিয়ে ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠান। উচ্চশিক্ষায় উন্নত ভদ্রলোক হওয়ার চেয়ে উন্নত কৃষক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তিনি বহু আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

কমছে মাটির উর্বরাশক্তি : প্রকৃতির বিপক্ষে চলে যাচ্ছে মানুষ। গাছ কেটে সাবাড় করছে বন-জঙ্গল। বেশি ফলনের আশায় মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কমে যাচ্ছে মাটির প্রকৃতিগত উর্বরা শক্তি। বিষের বিষবাষ্পে এখন ঘরে ঘরে হানা দিচ্ছে ডায়াবেটিস, আলসার, ক্যানসার। এসব দীনতা থেকে বাঁচতে হলে কৃষককে সচেতন করার বিকল্প নেই।

কমছে আবাদি জমি : নীতিমালা না থাকায় কৃষিজমি ব্যবহার করে বানানো হচ্ছে কল-কারখানা, ঘরবাড়ি, রাস্তা-ঘাট, ইটখোলা প্রভৃতি। ফলে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে  প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর কৃষিজমি। এশিয়ার প্রতিটি কৃষিভিত্তিক দেশই কৃষিজমি সংরক্ষণে কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে। পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গরে টাটা কোম্পানি কারখানা করতে চাইলে তা লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও দেওয়া হয়নি। চীন ও ভিয়েতনামে কৃষি আইন অনুসরণ করা হয় কঠোরভাবে। আশার কথা হলো, কৃষি আইন কার্যকরণে সরকার উদ্যোগী ও মনোযোগী হয়েছে। কৃষিজমি সংরক্ষণ আইন চূড়ান্ত হয়েছে। কৃষিজমিতে স্থাপনা নিষিদ্ধ হচ্ছে। লক্ষ্য রাখতে হবে- উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কৃষি জমি যেন নস্ট না হয়। কৃষি শুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী মোট কৃষিজমির পরিমাণ ১ কোটি ৯০ লাখ ৯৮ হাজার একর। দেশে পরিত্যক্ত জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৮৭ দশমিক ৪০ একর। এরমধ্যে ইজারার মাধ্যমে ১ হাজার ১৪৫ দশমিক ৫৩ একর সরকারের দখলে এবং ১ হাজার ৯৪১ দশমিক ৮৭ একর বেদখলে রয়েছে। অনাবাদী পতিত জমি ভূমিহীন ও বর্গাচাষীদের মাঝে বন্দোবস্ত করে দিলে উৎপাদনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

কৃষিক্ষেত্রে সৌর বিদ্যুৎ : বোরো মৌসুমে দেশে প্রায় বিশ লাখ একর চাষযোগ্য জমিতে ১৬ লাখ ৩০ হাজার সেচপাম্প ব্যবহূত হয়। এরমধ্যে ১৬ লাখ একর জমি চাষে ব্যবহার হয় ১০ লাখ ৮০ হাজার বিদ্যুৎচালিত সেচপাম্প। বাকি ১১ লাখ ৫৮ হাজার সেচপাম্প ব্যবহূত হয় ডিজেল চালিত। সারা দেশে বিদ্যুত ও ডিজেল চালিত সেচপাম্পগুলোকে সৌরবিদ্যুতের আওতায় আনা সম্ভব হলে বছরে ৭৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও ৮০ কোটি লিটার ডিজেল সাশ্রয় হবে। যারফলে ডিজেল ও বিদ্যুত ক্ষেত্রে সরকারের ৮৫৩ কোটি টাকা ভর্তুকি বেঁচে যাবে। এই ভর্তুকির টাকাটা পরপর ৩ থেকে চার বছর সৌরবিদ্যুতের পেছনে ভর্তুকি হিসেবে ব্যয় করলে সরকার পরবর্তী ২০ বছরের জন্য  ভর্তুকি প্রদান থেকে বেঁচে যাবে। পাশাপাশি জাতীয় বিদ্যুৎ তো সাশ্রয় হবেই।

জীবাণুু সার বাঁচাবে দু’হাজার কোটি টাকা : দেশে বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন ইউরিয়া সারের চাহিদা। এর মধ্যে ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন হবে ১৭ লাখ টন। বাকি ১৩ লক্ষ মেট্টিক টন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ইউরিয়া সাশ্রয়ের জন্য ডাল, তেল, শিমজাতীয় ফসল ও ধানে ইউরিয়ার পরিবর্তে জীবাণু সার ব্যবহার করা গেলে ২০০০ কোটি টাকার ইউরিয়া সাশ্রয় হবে। বাংলাদেশে জীবাণু সারের চাহিদা হবে ১ হাজার টন। এর প্রধান কাঁচামাল বাতাসের নাইট্রোজেন ও পিটমাটি বলে এটি ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদন সম্ভব। এ দুটো আমাদের দেশে প্রচুর আছে। পিটমাটি আছে ৬ লাখ হেক্টর জায়গায়।

বাড়াতে হবে গ্রামীণ বিনিয়োগ :  গ্রামের মানুষদের উপেক্ষা করে প্রকৃত উন্নয়ন অসম্ভব। গ্রামীণ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। গ্রাম এলাকায় অন্তত উপজেলা পর্যায়ে শিল্প কারখানা, গার্মেন্টস, কুটির শিল্প স্থাপনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে।  গ্রামীণ বিনিয়োগ বাড়লেই ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।  এলাকায় কাজ পেলে মানুষ আর শহরমুখী হবেনা। শহরে মানুষের অযাচিত চাপ কমবে।

সাফল্যগাথা : কৃষিকাজে ব্যবহারে জন্য ৩২টি কৃষিযন্ত্র আবিষ্কার করেছেন  ময়মনসিংহের গৌরিপুর উপজেলার নিরক্ষর কেনু মিস্ত্রী। অষ্টম শ্রেণি পাস যশোরের হান্টু মাছের হ্যাচারিসহ পুকুরে সাশ্রয়ী খরচে অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্র আবিষ্কার করে আলোচিত হয়েছেন। তার আবিষ্কৃত যন্ত্রে প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে ৯২ শতাংশ কম সময়ে ৮৫ শতাংশ কম ডিজেল বা বিদ্যুৎ খরচ বাঁচিয়ে সমপরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ সম্ভব। গোপালগঞ্জ জেলার সিমসন সাহা শিমুর উদ্ভাবন প্যাডেল চালিত সেচযন্ত্র। ডিজেল বা বিদ্যুৎ ব্যবহার ছাড়াই সাইকেলের প্যাডলে চালিয়ে তাঁর পানি সেচ মেশিন কৃষকের জন্য সাশ্রয়ী ও সহায়ক। যশোরের শার্শার আবু বকর সিদ্দিক উদ্ভাবন করলেন ওয়াটার ওয়েট পাওয়ার মেশিন। যে মেশিন দিয়ে জ্বালানি বিদ্যুৎ ছাড়াই কৃষিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হবে। এসব সাফল্যের তথ্য ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। জাতীয়ভাবে উদ্যোগ নিয়ে এসব কৃষিভিত্তিক মেধাকে কাজে লাগাতে হবে।

কৃষি উন্নয়নে কিছু অভিমত : ব্যবহারের সুযোগ না থাকা, ক্ষেত্র না জানা এবং সচেতনতার অভাবে প্রচুর মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। সেসব জমিকে উপযোগী করে ফসল, সবজি, ফল বাগান, নার্সারি প্রভৃতি ও পাশাপাশি ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়ন সম্ভব। পল্লী উন্নয়নের জন্য যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন আবশ্যক। কৃষক সমবায় সমিতিভিত্তিক উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। গ্রামের শিক্ষিত ব্যক্তি ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে কৃষকের জন্য কৃষি পাঠাগার স্থাপন করে সন্ধ্যাকালীন  পাঠচক্র করা যেতে পারে। কৃষি কর্মীদের উন্নত ও প্রযুক্তিভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে।  কৃষি কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলকভাবে মাঠ ও কৃষকের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন জোরদার করতে হবে। দেশে ১৩ হাজার নার্সারি উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে উন্নত ও মানসম্মত জাতে বীজ তৈরিতে দক্ষতা বাড়াতে হবে।  কৃষক পরিবারের সদস্যদের কুটির শিল্প স্থাপনে ব্যাংকঋণ সুবিধা সহজীকরণ করতে হবে।  সরকারের একটি বাড়ি একটি খামাড় প্রকল্প, কৃষি ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বিসিক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, বেসরকারি উদ্যোক্তা সবাই মিলে একযোগে টার্গেটভিত্তিক সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করলে সুফল আসবে।  কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। আসুন আমরা কৃষি ও কৃষকের কথা বলি। আমাদের নাড়ির টান গ্রাম বাংলার কৃষি ও কৃষকের সাথে। কৃষকের কথা ভাবুন, কৃষককে যথাযথ সম্মান করুন। আসুন, সবাই এক কণ্ঠে বলি— বাংলার কৃষক তোমাদের জানাই লাল সালাম।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads