ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম
দেশের কৃষি উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে জাতীয় কৃষিনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। সময়োপযোগী নীতি প্রণয়ন এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নে নেতৃত্বদানে সফলতার জন্য কৃষি উন্নয়ন ও খাদ্যনিরাপত্তায় উন্নয়নশীল বিশ্বে বাংলাদেশ রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য অনন্য। জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮-তে সবচেয়ে চমকপ্রদ সংযোজন হচ্ছে কৃষি উন্নয়নে ন্যানো প্রযুক্তি। জাতীয় কৃষিনীতির অনুচ্ছেদ ৩-এর ৩.৩-এ বর্ণিত গবেষণার পরিধি ও ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো ন্যানো প্রযুক্তিকে গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কৃষি উন্নয়নে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো হলো- ১. ফসলের রোগ নির্ণয়, জাতভিত্তিক পুষ্টি চাহিদা নির্ণয়, পুষ্টি আহরণ ক্ষমতা বৃদ্ধি; ২. ন্যানো সেন্সর প্রযুুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভূমির গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ এবং ৩. কৃষিতে ও কৃষি পরিবেশে ভারী ধাতুর উপস্থিতি শনাক্তকরণ ও শোধনসহ ন্যানো প্রযুক্তির সার, বালাইনাশক উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মাধ্যমে উপকরণ দক্ষতা অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণ। কৃষি গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে ব্যবহূত রাসায়নিক সারের ৫০ শতাংশের বেশি ও বালাইনাশকের ৯৮ শতাংশের বেশি নানাভাবে নন-টার্গেটেড জীব ও প্রতিবেশে অপচয় হয়। বর্তমানে এক কেজি চাল উৎপাদনে তিন-চার হাজার লিটার পানি ব্যবহার হয়। অস্বাভাবিক হারে অদক্ষ কৃষি উপকরণের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে শুধু যে ফসল উৎপাদন খরচ ভয়ানকভাবে বাড়ছে তা নয়, সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ও অব্যবহূত রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ক্রমে বিপন্ন করে তুলছে। এসব মোকাবেলায় কৃষিনীতিতে উপকরণের ব্যবহার হ্রাসের লক্ষ্যে যুক্তিসঙ্গত কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ন্যানো প্রযুক্তির গবেষণা ও প্রয়োগে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার ও গবেষণায় উল্লেখিত চিহ্নিত ক্ষেত্রগুলো নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী। কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ন্যানো প্রযুক্তি একটি কার্যকর ও সম্ভাবনাময় কৌশল হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। ন্যানো কণার ব্যবহার নাটকীয়ভাবে উদ্ভিদ পুষ্টি উন্নয়ন, সার ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি, ফসলে উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, পানি ব্যবস্থাপনা, রোগ নির্ণয়, বালাই দমন, খাদ্য মোড়কীকরণ, অজৈব অভিঘাত সহনশীলতা বৃদ্ধি এবং নিখুঁত (প্রিসিশন) কৃষি উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, নতুন ন্যানো কণা কার্যকরভাবে শস্য সংরক্ষণের জন্য বালাইনাশকের কার্যকারিতা ও নিরাপদ ব্যবহারে উন্নয়ন ঘটাতে পারে। অনুরূপভাবে ন্যানো সার স্লো রিলিজ বা ধীরে ধীরে উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী হওয়া এবং ধীর অবক্ষয়ের মাধ্যমে কার্যকরভাবে সার ব্যবহারের দক্ষতার প্রভূত উন্নয়ন করতে পারে। কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। তা সত্ত্বেও ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা সমাধানের জন্য গবেষণা করা প্রয়োজন। কৃষিতে ন্যানো কণা বাণিজ্যিকীকরণের আগে এর সম্ভাব্য ক্ষতিকারক দিকগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। সম্প্রতি প্রস্তুত করা ন্যানো কণা ও ন্যানো গঠনবিশিষ্ট পদার্থের অনন্য রাসায়নিক, ভৌত ও যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এসব কৌতূহলোদ্দীপক ন্যানো কণা হলো তড়িৎ চৌম্বকীয় সক্রিয় ন্যানো টিউব, ন্যানো তন্তু ও ফুলেরিন, এসব পদার্থে উচ্চসংবেদনশীল জৈব রাসায়নিক সেন্সর ধর্মের জন্য ব্যবহারিক প্রয়োগ যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। এসব ন্যানো সেন্সর কার্যকর মৃত্তিকা বিশ্লেষণ, সহজতর জৈব রাসায়নিক সেন্সিং ও নিয়ন্ত্রণ, পানি ব্যবস্থাপনা, রোগ নির্ণয়, বালাইনাশক ও পুষ্টি উপাদান ডেলিভারিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। ন্যানো প্রযুক্তির অন্য আরেকটি চমকপ্রদ ব্যবহার হচ্ছে কৃষিবর্জ্য থেকে উচ্চমূল্যের দ্রব্যাদি তৈরি এবং নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন করা।
লেখক : বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির
স্বর্ণপদক বিজয়ী কৃষি বিজ্ঞানী; অধ্যাপক, বায়োটেকনোলজি বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ঃড়ভধুুধষরংষধস—ুধযড়ড়.পড়স