কৃষি খাতে আমাদের অকল্পনীয় উন্নতি হয়েছে। কৃষি এখন শুধু ফসলের মাঠে নয়- মৎস্য, গবাদিপশু পালন, সবজি ও ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ থেকে শুরু করে নতুন নতুন কৃষিজ বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ ও সাফল্য দেশের সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে আশার আলো দেখাচ্ছে। ছাদ কৃষিতেও ব্যাপক সাফল্য, আগ্রহ ও জনপ্রিয়তা আশাব্যঞ্জক। দেশের অর্থনীতিতে কৃষির আনুপাতিক অবদান কমলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির দ্রুতগতির সঙ্গে সীমিত ও সংকোচিত হয়ে আসা জমিতে মোট কৃষি উৎপাদন বাড়ছে এটা অভাবনীয় ব্যাপার। কৃষিতে উৎপাদন বাড়ার পেছনে প্রধান উজ্জীবক শক্তি হিসেবে কাজ করছে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার এবং যন্ত্রের ব্যবহার। তার সঙ্গে বিশেষ অবদান রয়েছে আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ও গবেষণায় উচ্চফলনশীল, পরিবেশসহিষ্ণু এবং কম সময়ে ঘরে তোলা যায় এমন নতুন জাত উদ্ভাবন। ধান, পাটের পাশাপাশি খাদ্যশস্য, শাকসবজি, রকমারি ফল, সমুদ্র ও মিঠাপানির মাছ, গবাদিপশু, পোল্ট্রি মাংস ও ডিম, উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, দুগ্ধ উৎপাদন ক্রমেই বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ব উৎপাদন তালিকায় শীর্ষত্বের লড়াই করছে বাংলাদেশের কৃষি।
অবাক করা ব্যাপারটি হচ্ছে, স্বাধীনতার ৪৭ বছরে প্রায় ২০ শতাংশ চাষের জমি কমলেও চালের উৎপাদন বেড়েছে চারগুণ। কৃষিভিত্তিক আঞ্চলিক পর্যায়ে শিল্প স্থাপন এবং কৃষকের স্বার্থকে গুরুত্ব দিলে সর্বক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতার জোয়ার সৃষ্টি হবে এমন আশাবাদ এখন আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ের মধ্যে আবদ্ধ নেই। তবে আমাদের সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতি যে জায়গাটিতে আটকে আছে তা হলো কৃষিপণ্যের যথাযথ বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারা এবং উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না করা। তাই কৃষির মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন করতে চাইলে কৃষকের সমৃদ্ধির কথা সবার আগে বিবেচনা করতে হবে।
কৃষিতে বিশ্ব উদাহরণ বাংলাদেশ
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তিনটি বৃহত্তর খাত- সেবা, শিল্প এবং কৃষির মধ্যে কৃষির অবদান এখন তৃতীয়। দেশে কৃষিজমি কমলেও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছে। বেড়েছে কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার। সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সরকার কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। রাসায়নিক সারের দাম কমিয়ে আনা, পানি সেচের জন্য ব্যবহূত বিদ্যুতে ভর্তুকি, ৩০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রি, কৃষিঋণের সুদের হার হ্রাসকরণের সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ এখনো গ্রামে বসবাস করে। গ্রামে যারা বসবাস করেন, তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ ভাগ লোকের এখনো কৃষি খামার বা চাষাবাদ রয়েছে। অন্যদিকে শহরেও শতকার প্রায় ১১ ভাগ মানুষ সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত। মোট দেশজ উৎপাদনের হিসাবে জিডিপিতে এখন কৃষি খাতের অবদান শতকরা ১৫.৩৩ ভাগ। কৃষি খাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে ৪৮.১ ভাগ কর্মজীবী মানুষের।
কৃষিতে সাফল্য ঈর্ষণীয়
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বহুলাংশে কৃষি খাতের উন্নয়নের ওপর নির্ভরশীল। প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বিশ্বে পথিকৃৎ দেশের সুনাম এখন বাংলাদেশের। কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে বাংলাদেশ।
বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে আছে বাংলাদেশের নাম। বিশ্বে গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় তিন টন, আর বাংলাদেশে তা ৪ দশমিক ১৫ টন। আলু উৎপাদনের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় এবং আম উৎপাদনে বিশ্বে নবম স্থানে বাংলাদেশ। হেক্টরপ্রতি ভুট্টা উৎপাদনের বৈশ্বিক গড় ৫ দশমিক ১২ টন ছাড়িয়ে ৬ দশমিক ৯৮ টনের রেকর্ড বাংলাদেশের। বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশ এখন চাল, আলু ও ভুট্টা রফতানি করছে।
প্রতিকূলসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে
ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতাও আশাব্যঞ্জক। ১৯৭০ সাল থেকে দেশি জাতকে উন্নত করে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা উচ্চফলনশীল (উফশী) জাত উদ্ভাবনের পথে যাত্রা করেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ৬৭টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবন করেছে ১৪টি ধানের জাত। ১১৫টি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি) ৪১৭টি কমোডিটি ভ্যারাইটি অবমুক্ত করেছে। বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) ২৬টি জাত অবমুক্ত করেছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন এবং ছয়টি জাত অবমুক্ত করেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম জেনেটিক্যালি মোডিফাইড ফসল বিটি বেগুনের চারটি জাত অবমুক্ত করে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং মাধ্যমে আলুর নাবি ধসা রোগ প্রতিরোধী জিন প্রতিস্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। জানা গেছে, বর্তমানে দেশে বছরে বীজের চাহিদা সাড়ে চার হাজার টন, যার ৭০ শতাংশই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারজাত করে। এই বীজের ৬০ শতাংশ হাইব্রিড জাতের এবং বাকি ৪০ শতাংশ বারির বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত আধুনিক ও দেশি জাতের। এ পর্যন্ত ব্রি ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা সংস্থা-বিনার বিজ্ঞানীরা লবণসহিষ্ণু নয়টি, খরাসহিষ্ণু দুটি ও বন্যাসহিষ্ণু চারটি মোট ১৩টি প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এতগুলো প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের দিক থেকেও বিশ্বে শীর্ষস্থানে বাংলাদেশের নাম।
সম্ভাবনার জানালা ই-কৃষি ও কৃষক বাতায়ন
কৃষি তথ্য সার্ভিস দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে ২৪৫টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি) স্থাপন করেছে। এছাড়া ২৮ অক্টোবর ২০১৫ ইনফো-সরকার ২৫৪টি উপজেলার ২৫৪টি আইপিএম/ আইসিএম কৃষক ক্লাবকে এআইসিসিতে রূপান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষি তথ্যকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনলাইনে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে মুঠোফোনের জোয়ারে ভাসছে এই দেশ। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১০ শতাংশ মোবাইল ফোনের ব্যবহার বাড়লে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ হারে বাড়ে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের ১৬১২৩ নম্বরে যে কোনো মোবাইল থেকে ফোন করে নামমাত্র খরচে কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য বিষয়ে কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে। ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দেশ-বিদেশের কৃষি তথ্য সেবা পাওয়া যাচ্ছে।
বিশ্ববাজারে বাংলার কৃষিপণ্য
দেশের বাইরে দিন দিন বাড়ছে কৃষিপণ্যের চাহিদা। কৃষিপণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের পর তা রফতানির পরিমাণও বাড়ছে। জানা গেছে, ১০০’র বেশি প্রতিষ্ঠান সরাসরি খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও ১৪০টি দেশে রফতানি করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু প্রতিবেশী দেশগুলোতেই ১৫০ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য রফতানির সুযোগ আছে। কৃষিপণ্য রফতানি আয় বেড়েছে ৮০ শতাংশ। প্রতিবছর এ খাত থেকে রফতানি আয় বাড়ছে। ইপিবি সূত্রে জানা যায়, কৃষিপণ্য রফতানিতে আয় হয়েছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৫ কোটি ৩১ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্বের ৯০টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য রফতানি হয়। জানা গেছে, ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে দেশ থেকে প্রথম শাকসবজি রফতানি শুরু হয়। রফতানিকারকদের মতে, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে শাকসবজি ও ফলমূল রফতানির প্রচুর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাবে সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। হিসাবমতে বাংলাদেশে বছরে রবি ও খরিপ মৌসুম মিলে দেশে সবজি উৎপাদন হয় ১ কোটি ২৫ লাখ ৮০ হাজার টন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও হরটেক্স ফাউন্ডেশনের দুটি গবেষণা থেকে জানা যায়, উৎপাদিত সবজির ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ নষ্ট হচ্ছে সংগ্রহকারী, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতবদলের সময়, যার আনুমানিক মূল্য দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। এ অপচয় রোধের মাধ্যমে আমরা আরো বেশি পরিমাণ শাকসবজি রফতানি করে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি।
লেখক : কৃষি ও শিল্প-অর্থনীতি বিশ্লেষক ৎিরঃবঃড়সঁশঁষ৩৬—মসধরষ.পড়স