কুমিল্লার বরুড়ার কচুরলতি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে

ছবি: বাংলাদেশের খবর

আমদানি-রফতানি

দিনে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার কচুর লতি বিক্রি

কুমিল্লার বরুড়ার কচুরলতি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে

  • খায়রুল আহসান মানিক, কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

ধানের চেয়ে অধিকতর লাভজনক হওয়ায় কচু চাষের দিকে ঝুঁকেছেন কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার কৃষকেরা। এ বছর উপজেলার ২৫০ হেক্টর জমিতে কচুর চাষ হয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন ৩৬ টন কচুলতি বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে বিক্রি করছেন কৃষকরা। যার বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৫ লাখ ৪০হাজার টাকা।ভরা মৌসুমে দিনে ৮০টন কচুরলতি বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন বরুড়ার কচু ব্যাপারীরা। আর উৎপাদিত লতির ১০ শতাংশ বিদেশে রপ্তানি হয় বলে জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।

১শ’ বছরের বেশি সময় ধরে বরুড়ায় কচু লতির চাষ হলেও গত তিন বছর ধরে বিদেশি লতি রপ্তানি হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে অনেক বেশিমানুষ সম্পৃক্ত হয়েছে এ পেশায়। ধান চাষে লাভ তুলনামূলক কম ও ঝুঁকি থাকায়, লতি ও অন্যান্য শাকসবজি চাষে উৎসাহিত হচ্ছেন এখানকার কৃষকরা।

উপজেলার আগানগর, ভবানীপুর ও দক্ষিণ খোশবাস ইউনিয়নে বেশি কচু চাষ হয়। অন্যান্য ইউপিতে কচুর চাষ হলেও তা তুলনামূলক কম। এ উপজেলায় দুই ধরনের কচু বেশি চাষ হয়। একটি কচু লতি (কচুরাজ) আরঅন্যটি পানি কচু (স্থানীয় ভাষায় বরিশাইল্য াকচু)। কচুরাজে শুধুমাত্র লতি হয়। পানি কচুরলতি ও লতির ফলন শেষ হলে পুরো গাছসহ বিক্রি হয়। অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝিতে বরুড়ায় রোপণ শুরু হয় কচু গাছের। মাঘ মাস পর্যন্ত ধাপে ধাপে রোপণ করা হয় কচুগাছ। লতিরাজের চেয়ে পানিকচু রোপণ শুরু হয় তাড়াতাড়ি।ফলন শুরু হওয়ার পর একটানা ৮ মাস লতি পাওয়া যায়। মাঘ মাসে লতি কিছুটা কম পাওয়া গেলেও চৈত্র মাসে এর ফলনি দ্বগুণের চেয়ে বেশি হয়। শীতকালীন সবজির আধিক্য কমে যাওয়ায় এ সময়ে দামও পাওয়া যায় বেশি।  কৃষকরা জানিয়েছেন, সব মৌসুম মিলিয়ে গড়ে প্রতি কেজি লতির দাম পড়ে ২৫ টাকা করে, গাছসহ কচুর দাম পড়ে প্রতি কেজি ২০টাকা করে। কচু লতি চাষে প্রতি শতকে খরচ পড়ে ৮শ টাকা, পানি কচু চাষে প্রতি শতকে খরচ পড়ে এক হাজার টাকা।

বরুড়া উপজেলার দুই হাজার কৃষক কচু চাষের সাথে সম্পৃক্ত। পুরুষদের পাশাপাশি অনেক নারীরও কর্মসংস্থান হচ্ছে কচু চাষের মাধ্যমে। স্থানীয় কৃষকরা লতি তুলে বাড়িতে নেন, সে লতি পরিষ্কার করে আটি বাঁধেন নারীরা। আটি বাঁধা শেষ হলে স্থানীয় ব্যাপারীরা নগদ টাকা দিয়ে লতি কিনে নেন। তারপর ছোট ছোট ভ্যানে করে উপজেলার বিজয়পুর, আড়াওটি, বাতাইছড়ি, সরাপতি, মুগুজি, বারইপুর গ্রামের বিভিন্ন পয়েন্টে স্তূপ করা হয়। সেখান থেকে পিকআপ ভ্যানে করে কচুর লতি নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার কারওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম ও কৃমিল্লার নিমসারের আড়তদারদের কাছে। ছোট বড় ৫০ জন ব্যাপারী কচুর লতি সংগ্রহ করেন।কুমিল্লার বুড়িচংয়ের নিমসারে কচুরলতি বিক্রি করারজন্য আলাদা কর্নার রয়েছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকার আড়তদারদের কাছে বিক্রি হওয়া লতির একটি অংশ  অ্যাজেন্সির মাধ্যমে চলে যায় ইতালি, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে। ইতালি ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সকল দেশে কুমিল্লার বরুড়ার লতির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে দিনে একটন লতি বিদেশে রপ্তানি হয় বলে জানা গেছে।

এছাড়া কুমিল্লা থেকে ২০২০ সালে দেড় লাখ চারা দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করা হয়েছে। ২০২১ সালে এক লাখ চারা বিক্রি করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লতি রাজের চারা ৩ টাকা ও পানি কচুর চার ৪ টাকায় বিক্রি হয়। চারা রোপণের পর ভাদ্র মাসে গাছের মূল থেকে নতুন চারা গজায়। সে চারা বিক্রি হয়, আবার একই চারা দিয়ে বরুড়ার কৃষকরা নতুন নতুন জমি আবাদ করেন।

বরুড়ার আগানগরের কৃষক সেলিম মিয়া ৫০ বছর ধরে কচু চাষ করেন। এবার ১৭ শতক জমিতে কচুরাজ লাগিয়েছেন তিনি। খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। তিনি জানান, ‘এ জমি থেকে ৩০ হাজার টাকার লতি বিক্রি করবো। কচু চাষে লোকসান হয় না বললেই চলে, ফলনও হয় লম্বা সময় ধরে- তাই কচু চাষ করছি।’

উপজেলার দক্ষিণ জগদেশর গ্রামের কৃষক সানাউল্লাহ জানান, ‘১৮ শতক জমিতে পানি কচু চাষ করেছি। ১৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬০ হাজার টাকার লতি ও গাছ বিক্রি করতে  পারবো।’

তিনি জানান,‘সহজে কৃষি ঋণ পেলে ও কৃষি কর্মকর্তাদের আরও আন্তরিকতা থাকলে এ পেশায় আরও বেশিমানুষ সম্পৃক্ত হতো।’

আড়াওটি গ্রামের ব্যাপারী ছফিউল্লাহ বলেন,‘এখন অফ সিজন, তারপরও দিনে আড়াই টন কচুরলতি চট্টগ্রামের আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেন তিনি। এক মাস পর ভরা মৌসুম আসলে দাম ও বিক্রি দুটোই বাড়বে।’

চট্টগ্রামের আড়তদার রাসেল আহমেদ বলেন, ‘এখন এক টন লতি রপ্তানি হচ্ছে। ভরা মৌসুমে রপ্তানি বাড়বে।’

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্ভিদ সঙ্গ নিরোধ উইংয়ের উপ-পরিচালক শৈবালকান্তি দাশ জানান, ‘এ বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিবছর ২০০টন কচুরলতি বিদেশে রপ্তানি হয়। বেশি রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্যে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ সরকারের কন্দাল (মাটির নিচে যেসব উদ্ভিদের ফলন হয়) প্রকল্পের অধীনে বরুড়ার কচু চাষিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথমে কম সংখ্যক চাষিকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। ধীরে ধীরে অন্যান্য চাষিদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হবে। মূলত বেশি ফলন ও বিষ প্রয়োগ না করে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদের মাধ্যমে কীভাবে পোকামাকড় দমন করা যায়, সে বিষয়ে কৃষকদের দক্ষ করে তোল াহবে। এছাড়া উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

বরুড়া উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম জানান,‘ কৃষকরা চাইলে তাদের জন্য সহজ ঋণের ব্যবস্থা করবো। উপজেলার নারী-পুরুষ সবাই এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে-এটা বেশ আনন্দদায়ক।’

বরুড়ার নির্বাহী কর্মকর্তা আনিসুল ইসলাম বলেন,‘বরুড়া বাংলাদেশের কৃষিতে দারুণ ভূমিকা রাখছে। কচুরলতি রপ্তানি ও বিপণন বিষয়ে কৃষকদের সর্বোচ্চ সহায়তা করবে উপজেলা প্রশাসন।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads