স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদর বাড়াতে কারসাজির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

পুঁজিবাজার

কারসাজিতে বাড়ছে ছোট কোম্পানির শেয়ারদর

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২২ জুন, ২০১৮

মৌলভিত্তি নয়, শেয়ার-মূল্য নির্ধারণ হচ্ছে পরিশোধিত মূলধনের ভিত্তিতে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে যেগুলোর পরিশোধিত মূলধন তুলনামূলক কম, সেসব কোম্পানির শেয়ারই লাগামছাড়া বাড়ছে। স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদর বাড়াতে কারসাজির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাজার পরিস্থিতি খারাপ থাকলেও সম্প্রতি ছোট কোম্পানির শেয়ারদর প্রতিদিনই সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হচ্ছে।

কারসাজির অভিযোগে গতকাল একটি ব্রোকারেজ হাউজের বিরুদ্ধে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। গতকাল বিএসইসি জানায়, মুন্নু সিরামিক, মুন্নু জুট স্টাফলার্সসহ বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারে অস্বাভাবিক ও সন্দেজনক লেনদেনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ও এর গ্রাহকদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

চলতি বছরের শুরু থেকেই পুঁজিবাজারে দরপতন ছিল নিয়মিত বিষয়। এ সময় মৌলভিত্তির বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের বড় ধরনের দরপতন হয়। তবে দুর্বল, লোকসানি স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদর এ সময় ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। মাত্র তিন মাসে বেশ কয়েকটি ছোট কোম্পানির শেয়ারদর ৩৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে লিবরা ইনফিউশন, বঙ্গজ, বিডি অটোকারস, মুন্নু সিরামিকস, মুন্নু স্টাফলার্স, আজিজ পাইপস, সোনালী আঁশ, কে অ্যান্ড কিউ, উসমানিয়া গ্লাস, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক, লিগ্যাসি ফুটওয়্যারসহ বিভিন্ন স্বল্প মূলধনি কোম্পানি।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি হিসাববছরের ৯ মাসে মুন্নু জুট স্টাফলার্স কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হচ্ছে ২ টাকা ৯৫ পয়সা। আর এ শেয়ারটির দর বর্তমানে ৩ হাজার ৪৫২ টাকা। অথচ তিন মাস আগে এ শেয়ারের দর ছিল ৭৫০ টাকা। এ সময়ে শেয়ারটির দর বেড়েছে ৩৬০ শতাংশ। এ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন হচ্ছে মাত্র ৪৬ লাখ টাকা। শেয়ারটি নিয়ে কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে।

পুঁজিবাজারে মুন্নু জুট স্টাফলার্সের শেয়ার নিয়ে গুজব ছিল যে- কোম্পানিটি এবার ৫০০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ কিংবা একটি শেয়ারের বিপরীতে পাঁচটি রাইট শেয়ার ইস্যুর ঘোষণা দেবে। চলতি বছরের শুরু থেকেই এমন গুজব বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। আর ২০ জুন কোম্পানিটি তার অনুমোদিত মূলধন এক কোটি থেকে বাড়িয়ে ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীরাও অনেকটা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এবার বড় ধরনের বোনাস কিংবা রাইট শেয়ার ইস্যুর ঘোষণা আসতে যাচ্ছে। অবশ্য এ ঘোষণার আগে থেকেই এ কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ছে। আর গত কয়েক দিন ধরেই সর্বোচ্চ দরে কেনাবেচা হচ্ছে।

মুন্নু গ্রুপের অপর কোম্পানি মুন্নু সিরামিকের শেয়ার নিয়েও কারসাজি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ২০১৭ সালের আগস্টে এ কোম্পানির শেয়ারদর ছিল ৪১ টাকা। এ সময় কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পর্ষদে নতুন নেতৃত্ব আসায় শেয়ারদরে উল্লম্ফন দেখা হয়। বর্তমানে এ শেয়ারটি কেনাবেচা হচ্ছে ২৭৪ টাকায়। এ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ২৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা।

চলতি হিসাববছরের ৯০ মাসে শেয়ারপ্রতি আয়ে ১২ টাকা ৬৫ পয়সা লোকসান রয়েছে লিবরা ইনফিউশনস লিমিটেডে। তারপরও শেয়ারটির দর মাত্র ১১ কার্যদিবসে দ্বিগুণ হয়েছে। গত ৩১ মে এ কোম্পানির শেয়ারদর ছিল ৫০৫ টাকা। আর গতকাল এ শেয়ারটি কেনাবেচা হয়েছে ১ হাজার ২৭ টাকায়।

স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদর প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, বাজার পরিস্থিতি যখন খারাপ থাকে, তখন ছোট কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হয়। এটি দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এসব কারসাজির বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয় না। কারসাজি করে দাম বাড়ানোর সর্বোচ্চ পর্যায়ে যখন শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে চলে আসে, তখন তদন্ত কমিটি হয় এবং পরবর্তী সময়ে দর কমে গিয়ে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ ধীরগতি হওয়ায় কারসাজিকারকরাও উৎসাহিত হয়।

কারসাজি রোধ করতে বাজারে ভালো শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে হবে বলে মনে করেন আবু আহমেদ। তিনি বলেন, যেকোনো কারণেই হোক পুঁজিবাজার সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে না। পুঁজিবাজারের গভীরতা বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নেই। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যেও অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছু বলেননি। গত ১০ বছর ধরে চেষ্টার পরও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনতে পারেনি সরকার। আবার বিদেশি কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আসার বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতের ভালো কোম্পানি আসছে না। আবার আইপিওতে এমন কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, যাদের কোনো পরিচিতিই নেই। এমন পরিস্থিতিতে ভালো শেয়ারের অভাবে কারসাজি হচ্ছে।

কারসাজি হচ্ছে সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানির শেয়ার নিয়েও। গত তিন বছরে লোকসানে রয়েছে উসমানিয়া গ্লাস ফ্যাক্টরি। চলতি হিসাববছরের ৯ মাসেও এ কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান হচ্ছে ১ টাকা ৪৯ পয়সা। তারপরও শেয়ারটির দর বাড়ছে নিয়মিত। গতকাল এ শেয়ারটির সমাপনী মূল্য ছিল ১৬৮ টাকা ২০ পয়সা।

চলতি হিসাববছরের ৯ মাসে নর্দার্ন জুট ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের শেয়ারপ্রতি লোকসান ১০ টাকা ৩৮ পয়সা। তারপর শেয়ারটি লেনদেন হচ্ছে ৩০৬ টাকায়। এ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন হচ্ছে ২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। দুই বছরের লোকসান শেষে চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে সামান্য মুনাফায় এসেছে বঙ্গজ লিমিটেড। ছোট এ কোম্পানির শেয়ারদর এখন ২৬০ টাকা। স্বল্প মূলধনি আরেক কোম্পানি কেঅ্যান্ডকিউ কোম্পানি বন্ধ থাকলেও শেয়ারদর দুই বছরে বেড়েছে ৮৩২ শতাংশ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads