কক্ষে নারী থাকলে অস্ত্রোপচার ভালো হয়!

অস্ত্রোপচার কক্ষে কখনো কখনো গালাগালির মতো ঘটনাও ঘটিয়ে থাকেন পুরুষ শল্য চিকিৎসকরা

সংরক্ষিত ছবি

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

নতুন গবেষণা

কক্ষে নারী থাকলে অস্ত্রোপচার ভালো হয়!

  • তপু রায়হান
  • প্রকাশিত ৪ জুলাই, ২০১৮

অনেক সময় শোনা যায়, রোগীর পেটে গজ ব্যান্ডেজ, সিজার বা অন্য কিছু রেখেই সেলাই করে দেওয়া হয়েছে। এমন ঘটনা ঘটে অদক্ষতা ও অমনোযোগের কারণে। শল্য চিকিৎসকদের এমন ভুলে রোগীর শরীরে আবার কাটাছেঁড়া করতে হয়েছে। সে সময় প্রাণও দিতে হয়েছে অনেককেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী লরা জোন্স সম্প্রতি তার এক গবেষণার তথ্য উন্মোচন করেছেন, যা অস্ত্রোপচার কক্ষে শল্য চিকিৎসকদের শান্ত থাকতে সহায়তা করবে। ফলে গজ ব্যান্ডেজ, সিজার রেখেই সেলাই করার ঘটনাও কমে আসবে।

জোন্স দাবি করেছেন, গবেষণায় তারা দেখেছেন, অস্ত্রোপচার কক্ষে কখনো কখনো চিৎকার-চেঁচামেচি, গালাগালির মতো ঘটনাও ঘটিয়ে থাকেন পুরুষ শল্য চিকিৎসকরা। সেটা তারা করেন বড় কোনো কারণ ছাড়াই। তবে সে সময় যদি অস্ত্রোপচার কক্ষে কোনো নারী শল্য চিকিৎসক থাকেন তবে চিৎকার-চেঁচামেচির মতো ঘটনাগুলো কম ঘটে।

গতকাল মঙ্গলবার সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে এই তথ্য। প্রতিবেদনটি ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের এক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শুরু হয়েছে। সেখানে এক রোগীর অস্ত্রোপচার করার সময় হঠাৎ করেই রেগে ওঠেন প্রধান শল্য চিকিৎসক। তিনি সহকর্মী ও সহযোগীদের সঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দেন- তোমরা কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না? কী করো তোমরা? ওকে, আমি আর তোমাদের সঙ্গে চেঁচাচ্ছি না। বাই। এরপর ওই সার্জন গটগট করে অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। আর তার সহযোগীরা বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকেন।

এই ঘটনাটি ঘটে নৃবিজ্ঞানী লরা জোন্সের চোখের সামনেই। আসলে জোন্স অস্ত্রোপচার কক্ষে শল্য চিকিৎসকদের আচরণ নিয়ে একটি গবেষণার তথ্য সংগ্রহের জন্যই সেখানে ছিলেন।

তিনি এমন প্রায় ২০০ অস্ত্রোপচার পর্যবেক্ষণ করেন ও শল্য চিকিৎসকদের ৬ হাজার ৩৪৮টি আচরণের নোট নেন। তিনি দেখেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অস্ত্রোপচার কক্ষে নারী সহকর্মীরা না থাকায় শল্য চিকিৎসকরা চিৎকার-চেঁচামেচি বেশি করছেন। আর এটা বেশি ঘটেছে পুরুষপ্রধান শল্য চিকিৎসক ও কক্ষে উপস্থিত অন্যান্য পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে। তবে অস্ত্রোপচার কক্ষে কোনো নারী থাকলে বা প্রধান শল্য চিকিৎসক নিজে নারী হলে অনেক শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাজ শেষ হয়।

জোন্স ও তার দল এই গবেষণার উপাত্তগুলো গতকাল মঙ্গলবারই দেশটির জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমিতে জমা দিয়েছে বলেও সায়েন্স সাময়িকীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ও মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী জয়সি ওয়াহর এই গবেষণার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি অস্ত্রোপচার করার কক্ষে রোগীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করলেও নতুন এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন না। তবে তিনি বলেন, আমার মনে হয় না এখনো এভাবে কেউ ভেবেছে। আমরা মোটাদাগে ভাবতাম, কোনো চিকিৎসক স্বভাবতই চিৎকার-চেঁচামেচি করেন।

গবেষণার ধারণাটি প্রথম আসে এক অ্যানেসথেসিওলজিস্টের মাথা থেকে। তিনি গরিলা ও শিম্পাঞ্জির স্বভাব, তাদের মধ্যে ক্ষমতার বিরোধ নিয়ে জীববিজ্ঞানের এক বই পড়তে গিয়েই পান এই ধারণা। তখন তিনি সেই বইটির লেখক ফ্রানস দে ওয়াল এবং ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাইমেটিভ বিশেষজ্ঞকে জানান যে, শিম্পাঞ্জির আচরণগুলো যেভাবে পর্যবেক্ষণ ও যাচাই করা হয়েছে, অস্ত্রোপচার কক্ষেও সেভাবে একটা গবেষণা হতে পারে। সেখানেও আসলে কর্তৃত্ব ফলাতেই চিকিৎসকরা এমন আচরণ করে থাকেন।

অ্যানেসথেসিওলজিস্টের কথা শুনে লেখক ফ্রানস দে ওয়ালের মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। কারণ এত দ্রুত এ বিষয়ে এমন করে কেউ ভাবতে পারেনি। এরপর তিনি নৃবিজ্ঞানী লরা জোন্স ও তার কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে অস্ত্রোপচার কক্ষে শল্য চিকিৎসকদের আচরণ, সহযোগিতার মনোভাব, চিৎকার করার প্রবণতা- এই বিষয়গুলোকে চলক ধরে বিভিন্ন অস্ত্রোপচার পর্যবেক্ষণ করেন ও সেগুলোর আলাদা আলাদা ক্লাসিফিকেশন করেন।

তারা জর্জিয়ার ওই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে শল্য চিকিৎসক বা সার্জন, নার্স, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ও স্টাফদের মধ্যকার বিভিন্ন মিথস্ক্রিয়ার নোট নেন। পরে তারা সে আচরণগুলো মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করেন।

তারা দেখেন, যেসব অস্ত্রোপচার কক্ষে নারী শল্য চিকিৎসক ছিলেন বা পুরুষ শল্য চিকিৎসক থাকলে নার্স, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ও স্টাফদের মধ্যে নারী ছিলেন, সেখানে চেঁচামেচি প্রায় হয়নি বললেই চলে। আর তাদের সেইসব অস্ত্রোপচার কক্ষে মিথস্ক্রিয়াও ৬০ শতাংশ হয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে কক্ষে উপস্থিত নারীর অনুপাত ছিল তিন ভাগের দুই ভাগ। আর যেসব কক্ষে নারী কর্মীর তুলনায় পুরুষ শল্য চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি সেখানে মিথস্ক্রিয়া হয়েছে মাত্র ৩৯ শতাংশ।

এ বিষয়ে বার্মিংহামের আলাবামা স্কুল অব মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পেশাদার শল্য চিকিৎসক ডেভিড রজার বলেন, এই আবিষ্কার আসলেই অনেক গুরুত্ব বহন করছে। এটি হয়তো অস্ত্রোপচার কক্ষের কাজ ভালোয় ভালোয় শেষ করতে ভূমিকা রাখবে। তবে এটি নিয়ে এখন অনেক বেশি মাতামাতির কিছু নেই বলে মনে করেন ডেভিড রজার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads