ওয়াজ মাহফিল বাঙালি মুসলমানদের হাজার বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। উপমহাদেশে ইসলামের শাশ্বত বাণীর প্রচার ও প্রসারে ওয়াজ মাহফিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে বহু আগে থেকে। এই অঞ্চলের হক্কানি আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখরা ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামের মৌলিক বিধিবিধান, নবী-রসুল ও সাহাবায়ে কেরামদের জীবনাদর্শ, ইসলামের ইতিহাস ও অতীত ঐতিহ্যের গৌরবগাথা গ্রামবাংলার সাধারণ মুমিন-মুসলমানদের কাছে পৌঁছে দিয়ে থাকেন। সময়ের বিবর্তনে ওয়াজ মাহফিলের ধরন কিছুটা পরিবর্তিত হলেও জনপ্রিয়তা একটুও হারায়নি; বরং ওয়াজ মাহফিলের কলেবর আরো বর্ধিত হয়েছে। তাফসিরুল কোরআন মাহফিল, শানে রিসালাত মাহফিল, ক্বিরাত মাহফিল, ইসলামী গজল সন্ধ্যা, ইসলামী কবিতার আসর ও সাহিত্য আড্ডা এবং ইসলামী কনফারেন্স সবই এর বর্ধিত রূপ। সেই সঙ্গে এখন মাঠে ময়দানের ওয়াজ জায়গা করে নিচ্ছে অনলাইনেও। মুহূর্তে লাখ লাখ ভিউ, লাইক আর শেয়ারে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। কিন্তু অভিযোগ উঠছে, ইসলামের কথা বলতে গিয়ে অনেকেই ওয়াজ মাহফিলে উসকানিমূলক কথাবার্তা বলছেন এবং ওয়াজ মাহফিলকে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে কৌশলের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
আসলেই কি ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে মানুষের মাঝে উসকানিমূলক কথাবার্তা বলা হচ্ছে? এ বিষয়ে কথা হয় বিশিষ্ট বক্তা হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ওয়াজ নসিহতের বিষয়ে আল্লাহপাকের নির্দেশ এমন যে, তোমরা বিশুদ্ধভাবে মর্মস্পর্শী ভাষায় মানুষদের আমার দিকে আহ্বান করো। ওয়াজ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে সেটা হচ্ছে, যে কথাগুলো বলা হচ্ছে সেগুলো কোরআন অথবা হাদিসে আছে কিনা? কোনো দল বা ব্যক্তিকে কটাক্ষ করে ওয়াজের মধ্যে কথা বলা যাবে না। অনেক বক্তা এমন আছেন, যারা নিজ দলের বা মতাদর্শের কথা প্রচার করে এটা ঠিক নয়। আমি আশা করব, সবাই কোরআন হাদিস থেকে কথা বলবেন।
এ বিষয়ে আরো কথা হয় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সিনিয়র ইমাম মিজানুর রহমানের সাঙ্গে। তিনি বলেন, ওয়াজ মাহফিল এটা আমাদের একটা ঐতিহ্য এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তবে যারা ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য রাখেন, তাদের কিছু বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। যেসব বিষয় কোরআন হাদিসে নেই, সেসব বিষয় কোনোভাবেই বলা উচিত নয়। শুধু যে বিষয়গুলো কোরআন হাদিসে আছে, সে বিষয়গুলোই ওয়াজ মাহফিলে বলা উচিত। আরো একটি বিষয় হচ্ছে বাচনভঙ্গি। যারা ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দেন তাদের বাচনভঙ্গি অবশ্যই ঠিক করা প্রয়োজন। অনেক ভালো কথা বলা হয় কিন্তু বাচনভঙ্গি ভালো না হলে শ্রোতা বিষয়টিকে খারাপভাবে নিতে পারে। তাই ধর্মীয় বিষয়ে কোরআন হাদিসের অথেন্টিক বিষয়টি যেমন বলতে হবে, ঠিক তেমনি সুন্দর বাচনভঙ্গির সঙ্গে উপস্থাপনও করতে হবে।
চাঁদপুরের ইমাম রব্বানী দরবার শরিফের পীর সাহেব সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামের প্রতিটি কথা হবে শান্তির কথা। ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে মানুষকে ইসলামের পথে তথা শান্তির পথে আহ্বান করতে হবে। কিছু কিছু বক্তা আছেন, যারা ওয়াজ মাহফিলে সঠিক কোরআন হাদিসের কথা না বলে কোরআন হাদিসের বাইরের কথা বলে থাকেন এবং উসকানিমূলক কথাবার্তা বলেন। আমি আপনাদের মাধ্যমে বলতে চাই, সরকারের উচিত হবে এ বিষয়ে লক্ষ রাখা। ওয়াজ মাহফিলে যারা কোরআন হাদিসের বাইরে উসকানিমূলক কথাবার্তা বলেন, তাদের নিষিদ্ধ করা।
কোনো বিশেষজ্ঞ বলেন, আমাদের বড় একটি সমস্যা হচ্ছে আমরা কোরআন পড়ি না। একজন শিক্ষার্থী তৃতীয় শ্রেণি থেকে শুরু করে দাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এক ধাপ এক ধাপ করে তাফসিরসহ কোরআন পড়েন, তাহলে আজ যে বিভ্রান্তির কথা ছড়ানো হচ্ছে, তা আর সম্ভব হবে না।
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাজটা কী? পৃথিবীর অনেক দেশেই ধর্ম মন্ত্রণালয় ইসলামী বিষয়গুলো দেখে থাকে। অথচ আমাদের ধর্মীয় বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কোনো ভূমিকা দেখি না। ইসলামিক ফাউন্ডেশন একটি সেল গঠন করতে পারে, যারা ওয়াজের বিষয়গুলো মনিটর করবে। যাদের ওয়াজে ভুলত্রুটি পাওয়া যাবে, তাদের সংশোধন করার ব্যবস্থা করবে।
লেখক : আলেম ও গবেষক