পাকুটিয়ার জমিদার বাড়ি : টাঙ্গাইলের জমিদার বাড়িগুলোর মধ্যে পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি অন্যতম। নান্দনিক সৌন্দর্য আর দুর্লভ স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই জমিদার বাড়িটি আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জমিদার বাড়ি মানেই অপূর্ব কারুকাজ করা বিশাল ভবন। দেয়ালের পরতে পরতে সৌন্দর্যের ছোঁয়া। অন্যান্য জমিদার বাড়ির চেয়ে একটু হলেও বাড়তি সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার পাকুটিয়া জমিদার বাড়িতে। এখানে পাশাপাশি রয়েছে চমৎকার কারুকার্যখচিত বেশ কয়েকটি ভবন। প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে যা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ইংরেজ আমলের শেষ দিকে এবং পাকিস্তান আমলের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই ঘাট থেকেই তৎকালীন ব্রিটিশ রাজধানী কলকাতার সঙ্গে মেইল স্টিমারসহ মাল এবং যাত্রীবাহী স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল। ফলে নাগরপুরের সঙ্গে রাজধানী কলকাতার একটি বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এরই সূত্র ধরে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক মোগল আমলের সূচনালগ্নে নাগরপুরে সুবেদার খাঁ’র হাত ধরে নাগরপুরের বিখ্যাত ‘চৌধুরী’ বংশের আবির্ভাব ঘটে। আরো পরে সুবেদার খাঁ’র পথ অনুসরণ করে পশ্চিমবঙ্গ কলকাতা থেকে আসেন রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল নামে একজন বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি।
রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল প্রথমে ছনকায় অবস্থান নেন, পরবর্তীতে নদী ভাঙনের কারণে হাড়িপাড়া হয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমি পাকুটিয়াতে তার স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন।
জমিদার বাড়ির তিনটি স্থাপনাই অপূর্ব শিল্প সুষমামণ্ডিত। তিনটি বাড়ির সামনেই রয়েছে তিনটি নাট্যমন্দির। বড় তরফের পূজা মণ্ডপের শিল্পিত কারুকাজ শত বছর পর এখনো পর্যটককে মুগ্ধ করে। জমিদার বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ আর মাঠের মাঝখানে রয়েছে দ্বিতল নাচঘর। জমিদার বাড়ির মাঝে খোদাই করে লেখা রয়েছে, ১৯১৫ শ্রীযুক্ত বাবু ভূপেন্দ্র মোহন রায় ১৩২২ সন ২রা বৈশাখ ১৫ই এপ্রিল। বাড়িটি বর্তমানে পাকুটিয়া বি.সি.আর.জি ডিগ্রি কলেজের প্রশাসনিক ভবন ও ক্লাস রুম হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।
মহেড়া জমিদার বাড়ি : ব্রিটিশ শাসন নেই, নেই জমিদারের প্রতাপ, শুধু আছে তাদের স্মৃতিবিজড়িত কীর্তি। তেমনি একটি স্থাপত্য নিদর্শন হলো টাঙ্গাইলের মহেড়া জমিদার বাড়ি। প্রকৃৃতির অনিন্দ্য নিকেতন মহেড়া জমিদার বাড়ি তার রূপশোভা বিস্তার করে কালের নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৯০ দশকের পূর্বে জমিদার বাড়িটির পত্তন ঘটে। কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহা নামে দুই ভাই কলকাতায় লবণ ও ডালের ব্যবসা করে প্রচুর টাকা-পয়সা রোজগার করে চলে আসেন মহেড়া গ্রামে। এখানে এসে তারা এ সুবিশাল বাড়িটি নির্মাণ করেন। বাড়ি নির্মাণ করার পর তারা মহেড়া গ্রামের গরিব মানুষের কাছে টাকা দাদন খাটাতে থাকেন। এলাকার লোকেরা নির্ধারিত সময়ে টাকা না দিতে পারলে নিলামে তাদের সম্পত্তি কিনে নিতেন দুই ভাই। এতে অল্প কয়েক বছরের মধ্যে প্রচুর টাকার মালিক হন তারা। পরে ব্রিটিশ সরকার জমিদার প্রথা চালু করলে কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহার ছেলেরা করটিয়ার ২৪ পরগনার জমিদারদের কাছে থেকে একটি অংশ বিপুল অর্থের বিনিময়ে কিনে নেয়। শুরু হয় জমিদারি। কালীচরণ সাহা ও আনন্দ মোহন সাহার উত্তরাধিকারী রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী পর্যায়ক্রমে জমিদারি পরিচালনা করেন। জনশ্রুতি আছে, জমিদার তরফের সবচেয়ে পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন মহারাজ ভবনের গিরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী। তিনি ব্রিটিশ আমলে বিচারক ছিলেন এবং একাধারে নীতিবান ও প্রজাবৎসল ছিলেন। তিনি বিভিন্ন প্রজাতির পশু (বাঘ, হরিণ, ঘোড়া) ও পাখি (ময়ূর, টিয়া, ময়না) পালন করতেন।
কাছারিবাড়িতে বাঘের খাঁচা ছিল। বাঘটিকে আদর করে ফুলেশ্বরী বলে ডাকতেন। তাদের খাবারদাবারের খোঁজখবর নিজে রাখতেন। একদিন হঠাৎ করে বাঘটি খাঁচা থেকে বের হয়ে পার্শ্ববর্তী পাটক্ষেতে গিয়ে লুকায়। ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাখন লাল চক্রবর্ত্তী ও দেহরক্ষী মদনলালকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সেখানে যান এবং ফুলেশ্বরী বলে ডাকতে শুরু করলে বাঘটি এসে হাজির হয়। তারপর বাঘটিকে এনে খাঁচায় পুরে রাখেন।
নাগরপুর জমিদারবাড়ি : প্রায় দেড়শ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়ি। স্থানীয়ভাবে এটি চৌধুরীবাড়ি নামে পরিচিত। নাগরপুরের তৎকালীন জমিদার রায়বাহাদুর সতীশ চৌধুরী ৫৪ একর জায়গায় এ জমিদারবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
.jpg)
আর এ বাড়ি থেকেই তিনি শাসন কাজ পরিচালনা করতেন। এ জমিদার বাড়িতে রয়েছে অপূর্ব কারুকাজ করা বিশাল ভবনের সমারোহ। ভবনের দেয়ালের প্রতিটি পরতে পরতে সৌন্দর্যের ছোঁয়া এবং ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী বহন করে দাঁড়িয়ে আছে এগুলো।
অন্যান্য জমিদারবাড়ির চেয়ে একটু হলেও বাড়তি সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যাবে এই জমিদারবাড়িতে। এখানে পাশাপাশি কয়েকটি ভবন রয়েছে, প্রতিটি ভবনই চমৎকার কারুকার্যমণ্ডিত। একত্রে এত ঐতিহাসিক ভবন পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে নিঃসন্দেহে। শৈল্পিক কারুকার্যমণ্ডিত এই বাড়ির ভেতরেই আছে পরীর দালান। জমিদারবাড়ির একটি খাট (যা পালঙ্ক নামে পরিচিত) বর্তমানে স্থান পেয়েছে জাতীয় জাদুঘরে, একটি খাট, কাঠের তৈরি টেবিল, আলমারিসহ বেশকিছু ইতিহাসের স্মৃতি রয়ে গেছে স্থানীয় দর্শকদের জন্য। তবে লোহার সিন্ধুকসহ আনান্য জিনিস আজ শুধুই কাহিনী। কথিত আছে জমিদারি আমলে জুতা পরে ও ছাতা মাথায় দিয়ে জমিদারবাড়ির পাশ দিয়ে কেউ যেতে পারত না। তারপরও প্রজাহিতৈষী এই জমিদার এলাকায় স্কুল, কলেজ, দাতব্য চিকিৎসালয়, হাটবাজার, দিঘি প্রতিষ্ঠা করেন। এই অঞ্চলের লাখো মানুষের অসুখের কথা চিন্তা করে তারা সে সময় এখানে পুণ্ডরীকাক্ষ দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা আজ নাগরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হিসেবে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পর্যটকরা এর নির্মাণশৈলী দেখলে বুঝতে পারবে সে আমলে কীভাবে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হতো। হাসপাতালটি ছিল চিকিৎসার জন্য সুসজ্জিত ও পূর্ণাঙ্গ।





