আইনি জটিলতায় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বন্ধ থাকায় প্রায় ত্রিশ হাজার স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা চরম শিক্ষক সঙ্কটে ভুগছে। জোড়াতালি দিয়ে চলছে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম। বোঝাই যাচ্ছে কেমন চলছে এগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম। দেশে বইছে এখন নির্বাচনী হাওয়া। এ হাওয়া চলবে এ বছরের শেষদিন পর্যন্ত। তারপর কয়েক মাস চলবে তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া যারা ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেবে, তাদের শিক্ষার কী হবে- এ নিয়ে সুচিন্তিতভাবে ভাবার যেন কারোর সময় নেই। অথচ এসব মানুষ গড়ার কারখানা যদি ঠিকমতো না চলে, এদিকে যদি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের যথাযথ দৃষ্টি না থাকে, তাহলে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা কীভাবে আশা করব?
দেশের এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানভেদে ফাঁকা পদের অনুপাত ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে যথাযথ ক্লাস পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। যারা অর্থনৈতিকভাবে একটু সচ্ছল, তারা তো এ অবস্থায় কোচিং ও প্রাইভেট শিক্ষকের সহায়তা নেবেই। যাদের সে সামর্থ্য নেই, তারা কী করবে? রাষ্ট্র তাদের জন্য কী ব্যবস্থা রেখেছে? আমরা প্রায়ই বলতে শুনি প্রাইভেট টিউশনি ও নোটগাইডের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থা অত্যন্ত স্পষ্ট ও দৃঢ়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যেসব প্রতিষ্ঠানে অর্ধেক শিক্ষকই নেই, ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মূল শিক্ষাক্রমের কথা না হয় বাদই দিলাম, তথাকথিত পাস তো তাদের করতে হবে। সেটিও কি গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থীদের দ্বারা সম্ভব? আবার যেসব শিক্ষক আছেন, তাদের ওপরও বাড়তি ক্লাস নেওয়ার কারণে অতিরিক্ত চাপে ক্লাসের মান, শিক্ষাদানের মান নিম্নমুখী হতে বাধ্য। এর প্রতিকার কী? কে নেবে এর দায়-দায়িত্ব? অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বিদ্যালয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টানা ক্লাস নিতে হয়। টিফিন টাইম ছাড়া তাদের বিশ্রাম নেওয়ার মতো ন্যূনতম সময়টুকুও থাকে না। এই অবস্থা হলে কারোর কাছে কি এই পেশা আকর্ষণীয় মনে হবে? শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তারা কীভাবে মেজাজ ঠিক রেখে কথা বলবেন, ক্লাস পরিচালনা করবেন, সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের নিয়োজিত রাখবেন?
এই শিক্ষক সঙ্কট তো অর্থনৈতিক কারণে নয়। অবহেলা, অদূরদর্শিতা, রাজনীতি, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে এই শিক্ষক সঙ্কট। হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের চাকরি নেই আর আমাদের লাখ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষকের অভাবে ক্লাস করতে পারছে না। এত বড় বৈপরীত্য বিরাজ করছে শিক্ষাক্ষেত্রে! অর্থাৎ চূড়ান্ত ফল গিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর, শিক্ষার মানের ওপর। শিক্ষক সঙ্কট শুধু গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোতেই নয়, রাজধানীর অনেক স্কুলেও একই অবস্থা। ইংরেজি, বিজ্ঞান ও গণিতের মতো বিষয়ে শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়ে মারাত্মক বিপদে। কারণ এসব বিষয় তো শুধু নোট ও গাইড পড়লেই হয় না, এ বিষয়গুলো বোঝানোর জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষক।
তবে রাজধানীর যেসব স্কুলে বিষয় শিক্ষক নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অন্য স্কুলের টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়ে ঘাটতি কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারে। বাসার আশপাশে অনেক কোচিং সেন্টার আছে, সেখানে হয়তো কোনো শিক্ষক নয়তো বেকার কোনো ভালো ছাত্রছাত্রী, নয়তো কোনো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা ক্লাস নিয়ে থাকেন। শিক্ষার্থীরা গ্যাপ অনেকটাই মিনিমাইজ করতে পারে, যদিও শারীরিক পরিশ্রম হয় অনেক। ঢাকা শহরের অভিভাবকদের স্কুলের বাইরে কোচিং করানোর অর্থনৈতিক সামর্থ্যও রয়েছে। কিন্তু গ্রামের বিদ্যালয়গুলোর কী অবস্থা? উপরোক্ত বিকল্প পদ্ধতির কোনোটিই গ্রামে অবস্থিত নেই। অথচ তারা দেশের নাগরিক, সমঅধিকার ভোগ করা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। তাদের এ অধিকার রাষ্ট্র কীভাবে দেখছে? আমরা কোচিং বন্ধ করার জন্য, বাজারের নোটগাইড বন্ধ করার কথা বলছি প্রায় সবাই। কিন্তু বাস্তব অবস্থা তো এই। দেশের প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীদের কী অবস্থা? তাদের শিক্ষক নেই, পার্শ্ববর্তী কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে কিংবা ভালো কোনো উচ্চ শ্রেণির ছাত্রের কাছে পড়ার সুযোগ নেই। কারোর হয়তো পড়ার সুযোগ আছে কিন্তু নেই অর্থনৈতিক সামর্থ্য। তারা হয়তো কোনো রকমে একটি গাইড বই কিনে সেখান থেকে নিজেই শিক্ষক, নিজেই কোচিং, নিজেই শিক্ষার্থীর ভূমিকা পালন করে কোনোরকম পরীক্ষায় পাসের ব্যবস্থা করে। সেখানেও আমরা ধাক্কা দিচ্ছি। শিক্ষার্থীরা আসলে যাবে কোথায়?
বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য ২০০৫ সালে গঠিত হয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ বা এনটিআরসিএ। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি মোট ১৩টি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার কাজ সম্পন্ন করেছে। ২০০৫ সালের আগে এমপিওভুক্ত শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটি তাদের ইচ্ছাধীন ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে পারত। নিবন্ধন পরীক্ষা চালুর মাধ্যমে সেই স্বেচ্ছাচারিতায় কিছুটা ছেদ পড়ে। কিন্তু তারপরও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির তথ্য পাওয়া যায়। এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০১৫ সাল থেকে এনটিআরসিএ’র আওতায় সরাসরি পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়, যাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার সম্পূর্ণভাবে বাতিল হয়। দীর্ঘদিন ধরে ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ হতো বলে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ঘটনা ঘটে। এগুলো ঠেকাতেই ২০১৫ সাল থেকে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণ ও যোগ্যদের সুপারিশ করার ক্ষমতা প্রদান নীতিমালা সংশোধন করা হয়। ফলে সমাজের একটি অংশের অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। আর তাই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি মহল এনটিআরসিএ-কে বিভিন্ন ধরনের মামলায় ফাঁসিয়ে নাজেহাল করছে বলেও অনেক সংবাদপত্রে খবর এসেছে। বিষয়টি সত্যিও। শোনা যাচ্ছে, সরকারের শীর্ষমহল এনটিআরসিএ-র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে এখনো অনড়। এটি শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের জন্য সুসংবাদ বলতে হবে।
এনটিআরসিএ’র বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি ও এনটিআরসিএ মোটামুটি গুছিয়ে নিয়ে এসেছে। এটি সত্য যে, দুই বছরে শিক্ষক নিয়োগ দিতে না পারায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপক শিক্ষক সঙ্কট শুরু হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে অধিদফতরের পক্ষ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে শূন্য পদের সংখ্যা জানতে চেয়েছে এবং তারা এ পর্যন্ত ৩৮ হাজার ৮০০ শূন্য পদের চাহিদাপত্র সংগ্রহ করেছে। আরো কয়েক হাজার পাওয়া যাবে বলে আশা করছে মাউশি। তবে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বিষয়টির সুরাহা হওয়া দরকার। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক নেই, ক্লাস বাদ যাচ্ছে। অবশ্যই এটি গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্লাস যদি অশিক্ষক কিংবা যারা একেবারেই শিক্ষকতা পেশায় আসার উপযুক্ত নন, তারা যদি শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে যায় সেটি হবে আরো ভয়ঙ্কর। তাই যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার
ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি
সধংঁসনরষষধয৬৫—মসধরষ.পড়স