কদিন আগে অনেক বছর আগের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। তিনি সরকারি চাকুরে এবং বেশ প্রতিষ্ঠিত। লেখালেখি করেন। কথা বলতে বলতে তার মুখে সামগ্রিক বিশ্বব্যবস্থার নানা অলিগলি নিয়ে কথা হয়। কথা প্রসঙ্গে খাশোগি হত্যা নিয়ে কথা উঠল। নির্মমতার কী মর্মন্তুদ চিত্র! এই কী বর্তমান বিশ্ব? আমি বেশ কিছুদিন থেকে খাশোগি প্রসঙ্গে বিভিন্ন ক্লিপ দেখছি। সেই সঙ্গে ভাবছি সৌদি আরব ও আমেরিকার সম্পর্ক নিয়ে। এদিকে তুরস্ক-ইরান পক্ষের কথাবার্তাও দেখছি। মানুষ আর মানবতা এখন কোথায় দুলছে, ভাবতে অবাক লাগে। যুগে যুগে কত মানুষের ন্যায়হীন মৃত্যু ঘটেছে, কারো ঈর্ষায়, কারো উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথ পরিষ্কার করতে, ভাবতেই যেন অবাক লাগে। কিন্তু শেষপর্যন্ত মানুষ যে মরণশীল, এটা মানুষকেই ভাবতে হয়। এবং বারবার মানুষ তা ভুলেও যায়। কিন্তু এর বিপরীতে মৃত্যুকে অস্বীকার করেই যে মানুষ বেঁচে থাকে— এটাও তো সত্য। এই সত্যটা কখনো কখনো এত বেশি নিষ্ঠুরভাবে ছন্দহীন বিমূঢ়তায় ভরে ওঠে— ফলে নিজের মুগ্ধতায় তার প্রতিরোধ ক্ষমতায় সে সবকিছু অস্বীকার করে বিরাট এক পাপকেই যেন ধারণ করে বসে। এটাই জীবনসত্যের ট্র্যাজেডি। খাশোগিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। তারপর তার দেহ টুকরো টুকরো করা হলো। সেই টুকরোগুলো অ্যাসিডে গলিয়ে নোংরা নর্দমা দিয়ে মিশিয়ে নিঃশেষ করা হলো। কী তার অপরাধ? আর এ নিষ্ঠুরতারই বা অর্থ কী? এর তদন্ত চলছে। তদন্ত নিয়ে চলছে বাগ্যুদ্ধ। তবে যতদূর তথ্য, সৌদি যুবরাজের দিকে সন্দেহের তীর এবং এটা প্রায় এ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, সৌদি সরকারই এটা করিয়েছে। যথারীতি আমেরিকা সৌদি-পক্ষ নিয়েছে। তুরস্ক বিচার দাবি করছে। ইত্যাদি নানা পাকে-প্রকারে খাশোগি এখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একটা বড় ‘খাদ্য’। এই নিষ্ঠুর হত্যা-রহস্যের খাদ্য হজম করছে এখন গোটা বিশ্ববাসী। কিন্তু এর মৌল দিকটা কী? সেটা অনুসন্ধানের একটা বাসনা থেকে এ প্রসঙ্গটি আনা। মানবাধিকার, সাংবাদিকদের সত্যনিষ্ঠা, স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার, দ্বিমত পোষণ করার প্রয়াস, ভিন্নমতকে গুরুত্ব দেওয়া প্রভৃতি সবসময় ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই ক্ষমতার অধিষ্ঠাত্রী যারা, তারা তার গলা টিপে হত্যা করতে চেয়েছে। পদদলিত করতে চেয়েছে। নানাভাবে তার বিলুপ্তিরও চেষ্টা করেছে। এটা যুগে যুগে হয়ে যেমন এসেছে, তেমনি এ ধারা আজো, একালেও, সর্বদেশে, পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত তীব্রভাবে বহাল আছে। এই বহুল ক্রিয়া থেকে সমাজ এখনো সদুত্তর কিছু করতে পারেনি। এখন বুঝি সেই নিরুত্তর সমাজের নতজানু ও তোষামোদী কৃষ্টির জয়গান আরো বেশি ক্রিয়াশীল এবং কঠিনভাবে দৃশ্যমান করমর্দনে লিপ্ত। এ থেকে মুক্তি নেই, হয়ওনি। আর এর বাইরে যারা আছেন, তাদের কারো খাশোগির পরিণতি হয়েছে, কারো-বা বিচ্ছিন্নতা, কেউ পদদলিত, একাকিত্ব, নির্বাসিত, অভিবাসিত কিংবা কারা প্রকোষ্ঠের অন্ধকারে নিপতিত বা তথাকথিত স্বাধীন সমাজ-রাষ্ট্রে ভূলুণ্ঠিত করার শাণিত চেষ্টা হয়েছে। বলা যায় এখনো তা হয়ে চলেছে। তবে প্রশ্ন, মানুষের মুক্তি কোথায়? সভ্যতা কীভাবে এগোবে? কিংবা এই প্রযুক্তিবিশ্বে মানুষ কতটা এগিয়েছে, কীভাবে আমরা আধুনিক হচ্ছি বা স্বাধীন বিশ্বের জন্য তারস্বরে হুংকার ছেড়ে নিজেদের সঙ্গে প্রতারণা করে বেঁচে আছি, নিরন্তর; এবং আমাদের প্রজন্মকে এসব প্রতারণা বা নিষ্ঠুরতার ধারাবিবরণী শিখিয়ে চলেছি, অপঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি এবং তার দায় ও দায়িত্ব বিন্দুমাত্র নিচ্ছি না, নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করছি না। বিষয়টি সারা বিশ্বে, এই ক্ষুদ্র বাংলাদেশে তো বটেই— এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এখানে আশ্বস্ত বা বিশ্বস্ত কিছু করার কোনো সুযোগ নেই। প্রশ্ন আসে, তবে কী আমরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে এসব লিখছি? তা নয়। যে কাঙ্ক্ষিত বিশ্ব চাই বা যা রেখে যেতে চাই কিংবা যেভাবে যা কিছু শুনছি, করছি, বুঝে চলেছি তাতে কতটা সততা আছে— সে প্রশ্নটি থেকে এ ধরনের কথা প্রতিনিয়ত মনে আসছে। পুনর্বার নিজেকে প্রশ্নের মুখোমুখি করি।
বন্ধুটির প্রসঙ্গে ফিরে যাই। তিনি আরো বলেন, আপনি ট্রাম্পকে দেখুন, উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টকে দেখুন, দেখুন মিসর-সিরিয়া আর ইউরোপে। কিংবা পাশের দেশ ভারতকে দেখুন এমনকি পশ্চিমবঙ্গকে দেখুন— কে কম যায়! আর এই বাংলাদেশের তো সাপলুডুর রাজনীতির কথাই নেই। সব বাদ দিয়ে ফিরে আসি এই বাংলায়। এখন কত দল, কত নেতা, কত প্রার্থী, কত অনুসারী, কত অবসরপ্রাপ্ত, আসরপ্রাপ্ত লোক- সবাই নেমে পড়েছেন দল আর দেশ বাঁচাতে (?)। হায়রে দল, নেতা আর দেশ! অবক্ষয়ের চরম ব্যবস্থা সবার চোখে পড়ছে। যারা এসব করছে, তারাও জানে কী হচ্ছে আর যারা দেখছে তারাও বোঝে এসবের অর্থ কী! তাহলে দেশটার কী হবে? পরিণতি কী? সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? মানুষের ভাগ্যের চাকা তবে কোথায় রবে— কতসব তেলেসমাতি যে হচ্ছে— কেউ কি রাজনীতি করছেন? রাজনীতিটা আসলে কী? এটা কী সত্যিই রাজার নীতি? রাজা কী এতই শক্তিমান? প্রভু? ক্ষমতাধর? তার নীতিই কি সমাজের নীতি আর সেই নীতিতেই কি সব মানুষ চলবে? ভাবতে পারা যায় না। একসময় মনে হয়, শেকসপিয়র এই সমাজ দেখলে কেমন ট্র্যাজেডি লিখতেন! কিংবা সেই অসীম সুখে বৃষ্টিভেজা মানুষটি, চার্লি চ্যাপলিন কান্নাভেজা চোখে আরো হয়তো হাসতেন এবং একটি দারুণ কমিক লিখে ফেলতেন। খুব মনে পড়ে জোনাথন সুইফটের কথাও। কী অসাধারণ স্যাটায়ারিস্ট! এ সমাজে তাকেই পারফেক্ট মনে হয়। তিনি আরেকটা ‘গালিভার্স ট্রাভেলস’ লিখে ফেলতেন, বাংলাদেশে রাজনীতির মাঠে নামা এখনকার লোকদের নিয়ে। খুব মজার ফিল্ম হতে পারে। আইনের ফেরে এখন কেউ জেলে যাচ্ছেন, কেউ-বা মুক্তি পাচ্ছেন, কেউ-বা পালিয়ে আছেন, কেউ-বা ফিরে আসছেন; কারো স্ত্রী নেমে পড়েছেন, কারো কন্যা নেমে পড়েছেন ইত্যাদি কত কী! কারো অতীত-বর্তমান কিছু নেই। একটা চমৎকার মায়াজাল তৈরি হয়েছে। ভোটে দাঁড়ানো, প্রার্থী হওয়া। এক এক আসনে গণ্ডায় গণ্ডায় প্রার্থী। যার কথা কেউ ভাবেননি— তিনিও প্রার্থী। যাকে কেউ দেখেননি তিনিও প্রার্থী। আর চলছে কথার ফুলঝুরি। এসবের লক্ষ্য কী? উদ্দেশ্য কী? সবাই জানেন। যিনি দাঁড়িয়েছেন বা দাঁড়াতে চান, তিনিও জানেন আর যারা এসব দেখছেন তারাও জানেন। আশ্চর্য হে এপিসোড! নেমে আসুন চ্যাপলিন, একটা দারুণ কমিক আপনার জন্য অপেক্ষা করছে!
আসলে রাজনীতি নেই। সব ক্ষমতার লোভ। নিজের লোভ। প্রাপ্তির লোভ। দুর্নীতিকে স্বীকার করে নিয়ে চলার আকাঙ্ক্ষা। মূল্যবোধ বা জনস্বার্থের লেশমাত্র নেই। তা কেউ ভাবছেও না। যারা দুর্নীতিবাজ, তারা স্কেপ করার চেষ্টা করছেন। আইন বিচার নেই— সেটাকে আরো প্রতিষ্ঠিত করতে চান তারা। কারণ নিজেরাই ওর মধ্যে ডুবে আছেন। অপকর্ম থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে কেউ উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করছেন; কেউবা গলাবাজি করে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করছেন, সব নীতিকথা আওড়িয়ে নিজেকে একজন আদর্শবান হিসেবে প্রতিষ্ঠার অকিঞ্চিৎকর হীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন— প্রকারান্তরে সব হলো মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার পরিপূর্ণ চেষ্টা। এসব দিয়ে ভরে গেছে এখন সবটুকু, রাজনীতির আর লেশমাত্র কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ বুঝি এমন কথা বলবেও না, মানবেও না। এ রাজনীতি এ দেশে কেউ কি চেয়েছিল? চায়নি। যারা এখন করছেন, তারাও এমনটা অতীতে ভাবেননি, চাননি। কিন্তু এখন হয়ে গেছেন ফাঁকা কলসি। তীব্রভাবে নিজেদের গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। বিন্দুমাত্র তাতে সততার লেশমাত্র নেই। তা যদি থাকত তবে এসব নাটক এমনভাবে জমে উঠত না। তবে এর মধ্যেও আমার সরলীকরণ যা কিছু— সেখান থেকে আমরা বেরুতে চাই। এসব বিশ্বাস করতে চাই না। নিশ্চয়ই কোথাও কোনো মঙ্গল আছে! এর মধ্যেও অনেকেই ভালো আছেন। শান্তিপ্রদ, জনদরদী আছেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আছেন। দেশপ্রেমিক আছেন। মানুষকে শ্রদ্ধা করেন, ভোটারদের শ্রদ্ধা করেন এমন মানুষ আছেন। সেসব মানুষ এখনো বেঁচে আছেন, এই নষ্টদের মধ্যেও আছেন; বিশ্বাস করতে চাই না যে, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে গেছে।
খাশোগি হত্যার মতো অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, অনেক নিরপরাধ নারী-শিশু-যুবক এ পৃথিবীতে নির্বিচারে না বুঝেই বলি হয়েছেন। দেখা যায়, ইরান ইরাক আফগানিস্তান সিরিয়া কিংবা এই বাংলাদেশেও পাক-জান্তার হাতে মুক্তিযুদ্ধের সময়। নীতি আর আদর্শের কাছে প্রাণ দিয়েছেন অনেক যুবক। ব্রিটিশ ভারতে বিপ্লবীদের কাহিনী আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে আদর্শের দর্শনটি কী? ‘আদর্শ’ কি সোনার পাথরবাটি কিছু? মানবসভ্যতার ইতিহাসে আদর্শবাদের চর্চা নানাভাবে হয়েছে; কিন্তু আদর্শের পক্ষে-বিপক্ষে, যুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠরাই জিতেছে, সংখ্যালঘুরা পরাস্ত হয়েছে। আবার সংখ্যালঘু যারা, তারাই আদর্শের জন্মদাতা। তাদের আদর্শের পতাকাতলে বা ওই আদর্শ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে প্রাণবিসর্জনের ভেতর দিয়ে একসময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সংখ্যাগুরুর আদর্শিক প্রপঞ্চ।
কথাগুলো কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করি, সক্রেটিস তার জীবনে— সমাজে প্রতিষ্ঠিত হননি কিন্তু একটা সময়ের পরে তিনি সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এভাবে গ্যালিলিও বা জোয়ান আর্কের মতো অনেকেই। তারা একক ও সংখ্যালঘু ছিলেন কিন্তু তাদের আদর্শ এখন সংখ্যাগুরু। সেটা কেউ মানুক বা না মানুক, সভ্যতার অগ্রযাত্রায় তারা নিষ্পন্দ বাতিঘর— এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ আদর্শ বদলালেও তা ধ্বংস হয় না ঠিক কিশোরকালে পড়া গল্পের মতো : শক্তির নিত্যতা সূত্র— তার রূপান্তর ঘটে কিন্তু বিনাশ ঘটে না। তেমনি যা প্রকৃত তা বদলায় কিন্তু বিনাশ ঘটে না। আমরা আশা করি, বদলের ভেতর দিয়ে বদলাবো, রূপান্তরিত হব; এই বদলানোর প্রক্রিয়াটি এরকম যে, তাতে নতুন কিছু পাব। অনেকেই বলেন, একদম একশেষ হলেই জেগে উঠবে— নতুন কিছু। এটাই আশা। ফলে মানবতার জন্য সত্য কিছুর অপেক্ষায় যেমন অনেকেই আছেন তেমনি আমরাও; এখনকার তাৎক্ষণিক অবক্ষয়ের ভেতর থেকেই হয়তো নতুন কিছু জন্মাবে, সেজন্য জেনেবুঝেই সহ্য করছে বুঝি সবাই, আগামীটা বদলের আশায়।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়