লুৎফর রহমান লাভলু
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল, অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তথা এনজিও বহুল আলোচিত বিষয়। এনজিওগুলোর ব্যাপক বিস্তার ও কার্যকরী তৎপরতাই এর মূল কারণ। শহর থেকে গ্রামীণ পর্যায়ে এদের কর্মপ্রবাহ রয়েছে। উন্নয়ন, পানি নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি কর্মসূচির আড়ালে এনজিও মূলত সরকারিভাবে অনুমোদিত একটি বেসরকারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এদেশে এনজিওগুলো পাশ্চাত্য পুঁজিবাদীদের বিনিয়োগ দ্বারাই ফুলেফেঁপে উঠেছে। তাদের এই বিনিয়োগের মাধ্যমেই এনজিওগুলো বর্তমানে সফল ও শক্তিশালী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে এনজিও কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের অব্যবহিত পরে। নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত যুদ্ধবিধস্ত, ক্ষতবিক্ষত একটি দরিদ্র দেশের সরকারের একার পক্ষে বিপুল জনগোষ্ঠীর সাহায্য ও পুনর্বাসন করা ছিল দুরূহ ও অসম্ভব ব্যাপার। এ সময় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে এগিয়ে আসে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা।
বর্তমানে এসব এনজিও কৃষি, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প, ঋণ ও সঞ্চয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, মাতৃমঙ্গল ও শিশু পরিচর্যা, স্যানিটেশন, বনায়ন ইত্যাদি সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে। কিন্তু বাণিজ্যিক মনোভাব ও দারিদ্র্যের নামে মুনাফা লাভের মানসিকতা এনজিওগুলোর ভূমিকাকে বিতর্কিত করে তুলেছে। তথাপি এ কথা বলতে হবে যে, বাংলাদেশে কর্মরত এনজিওগুলো গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এদেশের বিপুল জনগোষ্ঠী ক্ষুধা, দারিদ্র আর অপুষ্টির শিকার। কঠোর পরিশ্রম করেও দরিদ্র মানুষ জীবনের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে অক্ষম। ফলে ক্ষুধা, দারিদ্র আর অপুষ্টি তাদের নিত্যসঙ্গী। ২০২১ সাল পর্যন্ত এনজিওগুলোর মোট ঋণ গ্রহীতার সংখ্যা অনেক। এসব সংস্থায় কর্মরত আছে দেশের লক্ষাধিক জনগোষ্ঠী। এ সুযোগেই তারা অসহায় ও দরিদ্র লোকদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করে নানা উপায়ে শোষণ করে যাচ্ছে। প্রথমত, এর নেতিবাচক দিক চোখে না পড়লেও দীর্ঘদিন তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে। ফলে দরিদ্র ও অসহায় মানুষ আরো নিঃস্ব হয়ে পড়ে। এনজিও কার্যক্রমের কুফলের কারণে আমাদের দেশের কেন্দ্র থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এক বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে, এ নেটওয়ার্ক দিনদিন শক্তিশালী হচ্ছে। বাণিজ্য করতে আসা ব্রিটিশ বেনিয়াগোষ্ঠীর মতো সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব নিয়ে কিছু কিছু এনজিওর কার্যক্রম ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে। এরা দেশের রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপ করছে, যা দেশের জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়। এছাড়াও জনসাধারণের দারিদ্র্য ও সরলতার সুযোগ নিয়ে বিদেশিরা এদেশে তাদের বিজাতীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারণার অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে এবং প্রভুত্ব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
এনজিওগুলো গ্রামীণ এলাকার লোকজনের মাঝে ঋণ প্রদান করে এবং সঞ্চয়ে উৎসাহিত করে। তারা গ্রামের মানুষদের নিয়ে সমিতি গঠন করে এবং তারা সাপ্তাহিক ও মাসিক সভা করে সিদ্ধান্ত নেয় এবং ঋণ গ্রহণ করে গরু, ছাগল কিনে সাবলম্বী হতে চেষ্টা করে। তবে এনজিওগুলো যে ঋণ দেয় তা নির্দিষ্ট কিস্তির মেয়াদে পরিশোধ করতে হয়। এই ঋণের টাকাও কিন্তু একেবারে কম নয়। তাছাড়া ঋণের টাকার সুদ বাড়তেই থাকে। ফলে একবার যে ঋণ নেয় তার পক্ষে কিস্তির মেয়াদে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয় না, দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই ঋণের সুদ টানতে হয়। শিক্ষা এনজিও কার্যক্রমের একটি দিক। শিক্ষা মানুষেরর মৌলিক অধিকার। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো গরীব ঘরের ছেলেমেয়েরা এই অধিকার হতে বঞ্চিত। যদি শিক্ষার সুযোগ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া যায়, তবে দরিদ্ররাও শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হবে। ‘সবার জন্য শিক্ষা’ বাস্তবায়নে সরকার যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে তা একার পক্ষে সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিশাল ছাত্রছাত্রীর তুলনায় স্কুল, শিক্ষক ও শিক্ষার সরঞ্জাম খুবই নগণ্য। আর ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কর্মসূচির আওতায় আসছে না। সরকারের এই সীমাবদ্ধতার সুযোগগুলো এনজিওরা গ্রহণ করে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার নামে কোটি কোটি ডলার নিয়ে আসে। এর সিংহভাগ ব্যয় করে তাদের নিজেদের জন্য। গ্রামের হতদরিদ্র শিশুদের শিক্ষার জন্য তারা খুব সামান্যই ব্যয় করে থাকে।
বাংলাদেশের অন্যতম আরেকটি প্রধান সমস্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যার কারণে গ্রাম-বাংলার মানুষ প্রায়ই গৃহহীন হয়ে পড়ে। এছাড়া গ্রামে অনেক দরিদ্র ও অসহায় মানুষ আছে যাদের গৃহ নির্মাণের সামর্থ্য নেই। এই দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের গৃহনির্মাণের জন্য এনজিওগুলো ঋণ প্রদাণ করে থাকে। তারা সুনির্দিষ্ট মডেলের গৃহনির্মাণ, নির্মাণসামগ্রী ও কারিগরি সহায়তার নামে গ্রামের অসহায় লোকদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে। ঋণের টাকা দিতে না পারলে তারা গোয়ালের গরু, ঘরের টিন খুলে নিয়ে যায়। অনেকে এই ঋণ থেকে বাঁচতে যে পাঁচ-দশ কাঠা সম্পত্তি থাকে তাও বিক্রি করে দিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়। তাছাড়া এনজিওগুলো উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে জরুরি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের বরাদ্দের সিংহভাগ গলাধঃকরণ করে থাকে। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং খাতগুলো থেকে ঋণ পায় না অসহায় ও দরিদ্ররা। কারণ তারা ঋণের বিপরীতে জামানতের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে না। ফলে এনজিওগুলো স্বল্পসুদে ঋণ প্রদাণ করে থাকে। কিন্তু দরিদ্র মানুষগুলো একবারে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারে না। ফলে তারা এনজিওগুলোর খপ্পরে পড়ে যায়। আর এটা এমন একটি চক্র, যে কোনো দরিদ্র মানুষ এখানে ঢুকলে আর বেরুতে পারে না। তাই এনজিওগুলো দারিদ্র বিমোচনের নামে দারিদ্র্য পুনরুদ্ধার করছে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধের নারী। নারীকে বাদ দিয়ে ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এনজিওগুলো এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নারী উন্নয়নের নামে বাংলাদেশের বঞ্চিত, অবহেলিত নারীদের সুসংগঠিত করছে। এর মাধ্যমে তারা গ্রামের অসহায় নারীদের ভ্রান্ত চিন্তা-চেতনায় উদ্ধুদ্ধ করছে। ফলে পারিবারিক সুখ-শান্তি যেমন বিনষ্ট হচ্ছে, তেমনি জাতীয় অগ্রগতিও ব্যাহত হচ্ছে। নারীদের ঘরের বাইরে বের করার অজুহাতে তারা নারীদের এমন সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে দিয়ে নিজেদের ফায়দা লুটছে। যা সমাজ, দেশ, জাতীর সামগ্রিক উন্নয়নের অন্তরায়। বর্তমানে এনজিওগুলোর ত্রুটির কারণে জাতীয় পর্যায়ে সুফলের চেয়ে কুফল বেশি। এনজিওগুলোর নেতিবাচক কাজ সম্পর্কে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদদের অভিমত হচ্ছে, এনজিও কার্যক্রম বিশেষত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের ফলে উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি হয়েছে, তেমনি সরকারের ক্ষতিও অনেক বেড়েছে। এনজিওগুলো যে ঋণ প্রদাণ করে তার পরিমাণ খুবই কম। যার দ্বারা উপার্জনে সক্ষম এমন কোন খাত তৈরি করা সম্ভব হয় না। সরকারি প্রশাসন ও এনজিওগুলোর মধ্যে যথাযথ সমন্বয়ের অভাব তা পরিলক্ষিত হয়েছে অনেকক্ষেত্রে। এনজিও কার্যক্রমে শুধু গ্রামের দরিদ্র লোকদের সম্পৃক্ত করা হয়। ধনী কৃষকদেরও এতে যুক্ত করতে পারলে সুদূরপ্রসারী ফলাফল আসবে কিন্তু তারা ধনীদের ঋণ প্রদানে যুক্ত করে না।
অনেকক্ষেত্রেই এনজিও দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করে। বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রম তুলনা করলে দেখা যায় যে, তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও ফলাফলে বিস্তার তফাৎ। যেমন— সরকারি সংস্থার মূল লক্ষ্য হলো জনগণের সেবা আর তাদের লক্ষ্য মুনাফা অর্জন। সমাজসেবার নামে এনজিওগুলো কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে চলেছে। এ কথা আজ ওপেন সিক্রেট যে, এসব এনজিও গ্রামের দরিদ্র জনগণের জন্য যে অনুদান পায়, তারা তা দিয়ে কর্মচারিদের বেতন ও আনুষঙ্গিক কাজে বেশি ব্যয় করে। এনজিওগুলো যদিও উন্নয়নে অবদান রেখেছে অনেকক্ষেত্রে, কিন্তু তা প্রত্যাশার চেয়ে খুবই নগণ্য। তারা তাদের স্বার্থ সম্পর্কে সজাগ হয়েই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়াও আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় যে, এই সংস্থাগুলো বিদেশি সাহায্যে পরিচালিত বিধায় বিদেশিদের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে থাকে, যা আমাদের দেশের স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা রাখে না। যার ফলে আর্থ-সামাজিক, কখনো কখনো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে।
পরিশেষে বলতে হয়, এনজিওগুলো যেহেতু ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে তাই এদের এক দিনেই দমানো যাবে না। দেশের সচেতন নাগরিক, সরকারের প্রশাসন, সুশীল সমাজ— সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং এনজিওগুলোর সাহায্যের নামে যে অর্থলুণ্ঠন করে পুঁজির বিস্তার ঘটাচ্ছে তার প্রতিরোধ সোচ্চার হতে হবে। এনজিওগুলোকে সত্যিকার অর্থে জনসেবার প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
লেখক : নিবন্ধকার