এখন ওয়েটলিফটিংই আমার সব : মাবিয়া আক্তার

মাবিয়া আক্তার

সংরক্ষিত ছবি

ফিচার

এখন ওয়েটলিফটিংই আমার সব : মাবিয়া আক্তার

  • প্রকাশিত ১৫ জুলাই, ২০১৮

গায়ের রং কালো বলে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। তা ছাড়া পড়াশোনায়ও বিশেষ মনোযোগ ছিল না মেয়েটির। মামার হাত ধরেই প্রথম খেলায় নাম লেখালেন। একসময় সমাজের কটূক্তির ভারে নুয়ে পড়া মেয়েটিই সোনা জয় করলেন বাংলাদেশের পক্ষে। হ্যাঁ, বলছিলাম মাবিয়া আক্তার সীমান্তের কথা। যার হাত ধরেই দক্ষিণ এশিয়ার গেমসে ভারোত্তোলনে স্বর্ণপদকের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। ‘গলায় স্বর্ণপদক নিয়ে স্যালুট তুলে কাঁদছেন মাবিয়া’- এক মিনিটের সেই ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে প্রচুর শেয়ার হয়েছিল। বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মাবিয়াদের পদক জয়ের পেছনের গল্পটা কি আমরা জানি? প্রতিনিয়ত পরিবার ও সমাজের প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে লাল-সবুজের পতাকা বিশ্বমঞ্চে উড়িয়ে চলা মাবিয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনিরা তাবাস্সুম

 

- কেমন আছেন?

মাবিয়া : ভালো আছি।

- আপনার খেলাধুলায় আসার পেছনের গল্পটা জানতে চাই। 

মাবিয়া : খেলাধুলায় আসার বিষয়টি একেবারেই হঠাৎ করে। আমি কখনো ক্রিকেট, ফুটবল এই খেলাগুলোও দেখতাম না। কিন্তু পাড়ার রাস্তায় ছেলেদের যত খেলা আছে সেগুলো খেলেছি। তবে খেলাকে পেশা হিসেবে নেব এমনটা কখনো ভাবিনি আমি বা আমার পরিবার। পরিবারের সদস্যরা বরং আমাকে বলত, তোকে নিয়ে আমরা কী করব। একে তো পড়াশোনায় ভীষণ ফাঁকিবাজ ছিলাম। অবশ্য এখনো আছি... (হাসি)

- এরপর শুরুটা কীভাবে হলো?

মাবিয়া : আমার মামা ছিলেন বক্সিংয়ের কোচ। একদিন বাবা ভীষণ মেরেছিল আমায়। তখন মামা বাসায় এসে আমাকে নিয়ে গেলেন জিম দেখাতে। আমি দেখলাম, কিন্তু তখন এসবের কিছুই বুঝলাম না। পরদিন মামা বললেন, তুমি যেগুলো দেখে এসেছ সেগুলো তোমাকে করতে হবে। মামাকে ভীষণ ভয় পেতাম, তাই মামার ভয়েই তখন হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম। পরে যেদিন প্রথম স্টিক হাতে ট্রেনিং করলাম আমার পুরো শরীর কাঁপছিল। ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছিলাম না। প্রথম দিনের এত পরিশ্রম আমার একদম ভালো লাগল না। বাসায় এসে মায়ের সঙ্গে বেশ রাগারাগি করলাম যে, আমি আর যাব না। এরপর মামা এসে আমাকে ধরে বেঁধে নিয়ে গেলেন। ওইদিনের পর থেকে এই খেলাটা যে কখন আমার এত প্রিয় হয়ে উঠল আমি নিজেই জানি না। এমনও হয়েছে, মামার আগেই আমি ট্রেনিং সেন্টারে গিয়ে বসে থাকতাম।

- এত খেলার মধ্যে ওয়েটলিফটিংকেই কেন বেছে নিলেন?

মাবিয়া : ওয়েটলিফটিং আমার পছন্দের খেলা ছিল না। এখন ওয়েটলিফটিংই আমার সব। আমার মামা আমাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ওয়েটলিফটিংয়ে আগে যারা এসেছেন তাদের কথা শোনাতেন। ওয়েটলিফটার ফাহিমা আক্তার ময়নার উঠে আসার কথা শোনালেন। তখন আমার মনে হলো এরা যদি পারে, তাহলে আমিও পারব। তাদের মতো না হোক কাছাকাছি তো যেতে পারব। ভাবলাম, ঠিক আছে চেষ্টা করে দেখি। একসময় দেখলাম ট্রেনিংয়ে যা শেখানো হয় সেগুলো আমার কাছে খুব সহজ মনে হয়। মনে আছে, মামা একবার বলেছিলেন-যদি তোমার ভাগ্য পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে স্পোর্টস এমন একটা জায়গা যেখান থেকে তুমি তোমার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে। আসলে নিজের ভাগ্যকে পরিবর্তন করার জন্যই পরিশ্রমটা মেনে নিয়েছিলাম। এরপর কখন যে এটা আমার ভালোবাসার জায়গা হয়ে গেল আমি নিজেও জানি না। 

- আপনার এমন সিদ্ধান্তে পরিবার থেকে কেমন সহযোগিতা পেয়েছেন?

মাবিয়া : আসলে আমার পরিবার আমাকে নিয়ে একটু হতাশই ছিল। যখন খেলা শুরু করলাম, তখন নানা সময় ইনজুরিতে পড়তে হয় বলে একসময় বাবা খেলতে নিষেধ করেছিলেন। তা ছাড়া আমার আত্মীয়রাও আপত্তি তুলেছিল। তখন আমি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, আমার খেলার বিষয়ে যেন আর কেউ কিছু না বলে। কারণ খেলাটা তখন আমার সঙ্গে এতটাই মিশে গেছে যে, এর বিষয়ে কেউ কিছু বললে আমি মেনে নিতে পারতাম না। খুব গায়ে লাগত। এরপর সবাই বিষয়টি মেনে নিয়েছিল। আমার পরিবারকে ধন্যবাদ যে, তারা আমার ওপর আস্থা রেখেছিলেন।

- খেলাধুলায় নারীর সম্পৃক্ততাকে বরাবরই একটু বাঁকা চোখে দেখা হয়। আপনার এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

মাবিয়া : আমার অভিজ্ঞতাও অন্যদের মতোই। এলাকার মানুষের কাছ থেকে অনেক বাজে কথা শুনতে হয়েছে। আমাকে প্রতিনিয়ত রাস্তায় বিরক্ত করা হতো। ঠিক মতো ট্রেনিংয়ে পর্যন্ত যেতে পারতাম না। প্রচণ্ড মানসিক চাপ দিয়েছে। কেউ কেউ বাবাকে এভাবেও বলেছে যে, শেষ পর্যন্ত মেয়েকে দিয়ে টাকা রোজগার করছ। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে বাবা বা ভাই আমাকে ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়ে আসতেন।

- এখন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন?

মাবিয়া : মজার বিষয় হলো, এখন বাস্তবতা অনেক বদলে গেছে। এখন  ঠিক ওই মানুষগুলোই আমি রাস্তায় বের হলে খোঁজ নেয়। রিকশা না পেলে রিকশা পর্যন্ত ঠিক করে দেয়। এটুকু পরিবর্তনও কিন্ত্তু এসেছে নিজেকে প্রমাণ করার পরে, তার আগে নয়।

- কেমন লাগে এই পরিবর্তনটা দেখে?

মাবিয়া : ভালোই লাগে ভাবতে। আজ আমি প্রমাণ করতে পেরেছি বলে তাদের কাছে ভালো। কিন্তু আমার মতো আরো পাঁচটি মেয়ে তো ধৈর্য ধরবে না। তারা কি ধৈর্য ধরে বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে? আমার ইচ্ছা আছে, যখন আমি আর এ পেশায় থাকব না, তখন এ পেশার অন্যদের অনেক সাপোর্ট করব। কারণ যে সাপোর্টটা আমি পাইনি সমাজের কাছ থেকে; আমি চাই না আর দুটি মেয়েও তা না পাক।

- এখন বর্তমান প্রসঙ্গে আসি। আগামী মাসেই এশিয়ান গেমসের পর্দা উঠবে, এর জন্য প্রস্তুতি কেমন চলছে?

 মাবিয়া : প্রস্তুতি ভালোই চলছে। সপ্তাহে ৬ দিন ৫ ঘণ্টা করে ট্রেনিং করছি।

- আপনাদের প্রশিক্ষণের কোনো বিষয়ে ঘাটতি আছে কি?

মাবিয়া : প্রশিক্ষণের যন্ত্রপাতির কথা যদি বলতে হয়, তাহলে বলব এখানে এখনো যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গেছে। ২০১০ সাল থেকে আমি যে জিমনেশিয়াম পেয়েছি এখনও সেটি তেমনই আছে, কোনো পরিবর্তন হয়নি। উন্নত কোনো সুযোগ-সুবিধা আমরা পাইনি। এর মধ্য থেকেই আমরা পারফরম্যান্স করেছি। ভালো সুযোগ-সুবিধা পেলে আরো ভালো করতে পারতাম।

- এশিয়ান গেমসে ভালো পারফরম্যান্সের জন্য আপনার এখন কী প্রয়োজন?

মাবিয়া : ভালো পারফরম্যান্সের জন্য প্রথমেই একটা ভালো জিমনেশিয়াম দরকার। একজন কোচ দরকার এবং যথাযথ ট্রেনিং সুবিধা প্রয়োজন। এগুলো পেলে আমার মনে হয়, অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারব। কিন্তু আমাদের ফিজিও নেই, ফরেন কোচ নেই, ভালো সুযোগ-সুবিধা নেই, কিছুই নেই। আমাদের একজন সার্বক্ষণিক ফিজিও প্রয়োজন। কিন্তু এর কিছুই দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু কোথাও গিয়ে পারফরম্যান্স খারাপ হলে একগাদা কথা শুনতে হয়। কিন্তু এর পেছনে যে কর্তৃপক্ষেরও কিছু দায়ভার আছে, তা তারা মানতে নারাজ।

- কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ায় ইনজুরিতে পড়েছিলেন, তার অবস্থা কী? এখন কোনোরকম ইনজুরি আছে কি?

মাবিয়া : হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার পর কোমরে যে ব্যথা পেয়েছিলাম সেটা এখনো রয়ে গেছে। বিশ্রামের কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু বিশ্রাম তো সেভাবে নেওয়ার সুযোগ হয়নি। এ ছাড়া আমার হাতের ইনজুরিটা এখনো সারেনি। তবুও প্রস্তুতি চলছে।

- এ পর্যন্ত কয়টি পুরস্কার ঝুলিতে জমা হলো?

মাবিয়া : আন্তর্জাতিক গোল্ড মেডেল পেয়েছি চারটি। এর মধ্যে ভারতে ২০১৫ সালে একটি, গোহাটিতে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমসে একটি, এশিয়ান ওয়েটলিফটিং চ্যাম্পিয়নশিপ কাতারে দুটি গোল্ড মেডেল পেয়েছি। এ ছাড়া ন্যাশনালে গোল্ড মেডেল পেয়েছি পাঁচটি।

- আপনার কি মনে হয় আপনাদের সাফল্যের কারণে আজ খেলার মাঠে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে?

মাবিয়া : হ্যাঁ, অবশ্যই। 

- খেলাধুলায় আগ্রহী নারীদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

মাবিয়া : নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দিতে হবে সবচেয়ে বেশি। সমাজের চারপাশের লোকজন সবসময়েই পেছনে টেনে ধরতে চাইবে। এতে থেমে না গিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads