একজন সার্থক মুসলিম নেতা

রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান

ছবি : ইন্টারনেট

ফিচার

রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান

একজন সার্থক মুসলিম নেতা

  • মনযূরুল হক
  • প্রকাশিত ২৯ জুন, ২০১৮

একজন রাজনীতিক কবিতা পাঠের জন্য জেল খেটেছেন। এরদোগান সম্পর্কে সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা এটাই। সেটাও এমন একসময়ে, যখন তিনি দেশের ক্ষমতাসীন দলের নেতা, তার দল একে পার্টি পার্লামেন্ট নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। কিন্তু কবিতা পাঠের অপরাধে রাষ্ট্রীয় শাস্তি ভোগ করায় তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারছেন না। যদিও অবশেষে প্রধানমন্ত্রী তিনি হয়েছেন বটে, কিন্তু সেজন্য নানা আইনি জটিলতা পেরুনো ছাড়াও তার দলের সিনিয়র একজন সদস্যকে নিজ আসন থেকে পদত্যাগ করিয়ে সে-আসনে তাকে উপনির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে আসতে হয়েছে। তুর্কি জাতীয়তাবাদী কবি জিয়া গোকাল্পের সেই কবিতাটির কথা তুরস্কের জনগণ আজীবন মনে রাখবে- Mosques are our barracks. domes our helmets, minarets our bazonets, belevers our soliders। ১৯২২ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হয় তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট আতাতুর্ক মোস্তফা কামাল পাশার হাত ধরে। তিনি যে সেকু্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন, তা তার মৃত্যুর পরও সত্তর বছর বলবৎ ছিল পরবর্তী ১০ প্রেসিডেন্টের কল্যাণে। কিন্তু মানুষ তাতে ধর্মভোলা ‘আধুনিক’ হলেও তুরস্ক ধীরে ধীরে জীর্ণ ও দরিদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছিল। ফলে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে জনসাধারণ। এই সুযোগে কট্টর ইসলামিজম নিয়ে হাজির হন নাজমুদ্দিন আরবাকান। কিন্তু রাষ্ট্র তা গ্রহণ করেনি। এরপরই সেক্যুলার দেশে নতুন নীতি নিয়ে আসেন এরদোগান- যাকে বলে, কনজারভেটিভ ডেমোক্র্যাসি বা রক্ষণশীল গণতন্ত্র। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নেও ঈর্ষণীয় সফলতা দেখান তিনি। আর ঘোষণা করেন, ‘ধর্ম পালনে কাউকে বাধ্য যেমন করা যায় না, তেমনি কাউকে বাধা দেওয়াও যাবে না।’ এভাবে হিজাবের প্রতি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামা ঘোষণা দেন, ‘একজন নেতা কীভাবে একইসঙ্গে ইসলামিক, গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এরদোগান। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইসলাম, অর্থনীতি ও গণতন্ত্রকে সমন্বিত করে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি রোল মডেল সৃষ্টি করেছেন তিনি।’

১৯৭২ সালে যখন ‘মারমারা’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়েন, তখনই ছাত্র-আন্দোলনে যোগ দিয়ে নেতৃত্বে আসেন তিনি। ১৯৫৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি  জন্ম তারিখ ধরলে সে-সময় তার বয়স মাত্র ১৮। ইস্তাম্বুলের মানুষ তিনি, শৈশব কেটেছে কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে। দরিদ্র পরিবারে তুর্কি কোস্টগার্ডের চাকুরে বাবা ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম। সংবাদমাধ্যমের সামনে বহুবার নিজের গল্পে বলেছেন- ‘বাবাকে সাহায্য করার জন্য তরমুজ বিক্রি করা ছাড়া উপায় ছিল না। এ-দিয়ে শিক্ষার খরচও জোগাতাম।’ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করেন ‘ইমাম হাতিব’ মাদরাসায়। বইপড়া তার অস্তিত্বে পাগলামির মতো জেঁকে বসে। বই কেনার অর্থ জোগাতে তুরস্কের রাস্তায় লেবু ও তিলের খাজা বিক্রি করেছেন। মেহমেত আকিফ এরোজির ‘সাফাহতে’ গ্রন্থ তার প্রিয় বই। তিনি বলেন, ‘নিঃসন্দেহে পবিত্র কোরআন থেকে শুরু করে সব ধর্মগ্রন্থের চিরায়ত গুরুত্ব রয়েছে। প্রত্যেক জাতির নিজস্ব মূল্যবান সাহিত্যকর্মও রয়েছে। মাওলানা রুমী ও ইউনুস আমাদের এখানে আনাতোলিয়ায় বসে লিখেছেন। তাদের সৃষ্টিও ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়।’

একহারা লম্বা বলিষ্ঠ গঠনের এই মানুষটিকে কাছে দেখলে মনে হয়, কঠিন পাষাণের মতো। মনে হয়, সবসময় তিনি গভীর ভাবনায় ডুবে আছেন। মনে হয়, এখনই তিনি ‘আমি খুব ব্যস্ত, পরে কখনো দেখা হবে’ বলেই সামনে থেকে চলে যাবেন। তাই তার আন্তরিকতাকে একটু বাহুল্যই মনে হয়। প্রতিদিন ডায়রিতে আপন অভিজ্ঞতা লিখে রাখেন সযত্নে। তবে ভুলে যান না যে, তিনি একজন রাজনীতিক। বাকস্বাধীনতার কথাও মনে রাখেন খুব। বহুবার কবি এ টি আয়হানের একটি পিক্ত বলেছেন, ‘আমরা হয়েছি বড় নিষেধের বেড়াজাল ভেঙে-ভেঙে।’

২০১৪ সালের আগস্টে সিএনএনের এক সাংবাদিক যখন বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আসন্ন এবং আপনি প্রচারকাজে ব্যস্ত, ক্লান্ত..।’ তিনি জবাব দেন, ‘রাজনীতিতে আমি ক্লান্ত হই না। আপনি কি সাংবাদিকতায় ক্লান্ত?’ ক্ষমতার প্রথম দিকে তিনি তুরস্কের জাতীয় সংসদে ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজকে ভাষণের সুযোগ দেওয়ার নজির সৃষ্টি করেন। কিন্তু ২০১৪ সালে এসে তিনি ইসরাইলের আগ্রাসনকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেও বিবৃতি দেন। ফলে তার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের অভিযোগ ওঠে- তিনি একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে ইসলামাইজেশনের পথে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে দেশের মানুষ যে তাকে ভালোবাসে, এ-ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। নইলে জাতীয় নির্বাচনের একবছর আগে একটা রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা, নির্বাচনে গিয়েই বাজিমাত, এককভাবে সরকার গঠন, তারপর একে একে পাঁচটি নির্বাচন, সবগুলোতে জয়ী এবং তা-ও সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে- ভাবা যায়? এমন জনপ্রিয়তার কারণেই গত বছর সেনা-ক্যু শক্তভাবে রুখে দিতে পেরেছে তারা, যা গত ৯৩ বছরের ইতিহাসে আর কেউ পারেনি। এমনকি এত কিছুর পরও ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তা প্রদানকারী দেশগুলোর শীর্ষে নিয়ে গেছেন তুরস্ককে।

এবার আবার তুরস্কের ১৯তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন এরদোগান। রাজনীতিতে আসার আগে তিনি পেশাদার ফুটবলার ছিলেন। ফুটবল বিশ্বকাপের এই সময়ে পৃথিবীজুড়ে চলা সব সমালোচনাকে দুর্দান্ত গতিতে পাশ কাটিয়ে গোলপোস্টে ঠিকই সেঁধিয়ে দিয়েছেন তার বল। বিরোধী দলের নেতা মুহাররেম ইনজি বলেছেন, ‘আমি এই ফল মেনে নিলাম। আট কোটি মানুষের প্রতিনিধি এখন এরদোগান। এখন তিনি আমাদের সবার প্রেসিডেন্ট।’ আর এরদোগান বলেন, ‘তুরস্কের ৮ কোটি ১০ লাখ জনগণের প্রত্যেকে এই বিজয়ের অংশীদার।’ আমরা প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সর্বাঙ্গীণ সুন্দর জীবন কামনা করি।

লেখক : রিসার্চ ফেলো, মাহির’স কোরআনিক রিসার্চ সেন্টার

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads