মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে জাতিগত ঐক্যের প্রদর্শন করে বিশ্ব দরবারে উজ্জ্বল নিদর্শন স্থাপনের বদলে বাংলাদেশে আদর্শিক রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ও সহিংসতার জেরে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। হেফাজতে ইসলামের তথ্যমতে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদী আন্দোলনে তাদের ১৭ জন কর্মী নিহত ও ৫ শতাধিক আহত হয়েছে। সরকারি তথ্যের সাথে এ তথ্যের গরমিল থাকলেও দেশে সাম্প্রতিক সময়ে সম্প্রীতি নষ্টের ঘটনা ঘটেছে এটিই মূল বিষয়।
২০২০ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণের খবর প্রকাশিত হলে বিএনপি, বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দল ও অধিকাংশ বাম দলসমূহের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ ও নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণ প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল। ভারতের দিল্লি, গুজরাটসহ বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘুদের হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় নরেন্দ্র মোদিকে দায়ী করে বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করার মধ্যেই করোনা হানা দিলে সকল অনুষ্ঠান আয়োজন স্থগিত রাখা হয়।
পরবর্তীসময়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখার খবর প্রকাশ হলে বিএনপি এবং সিংহভাগ বাম দলসমূহ আক্ষরিক অর্থে কোনো প্রতিবাদ না করে নীরব ভূমিকা পালন করলেও আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ। সরকার ও প্রশাসন মোদিবিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে কঠোর অবস্থানে থাকার ঘোষণা দিলেও ২৫ ও ২৬ মার্চ মোদির আগমনবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে বিক্ষোভকারীরা। সরকার চাইলেই সংসদ ও সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ, বিভিন্ন ইসলামী দলসমূহের নেতাদের সাথে মতবিনিময় করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বর্ণিল উদ্যাপন আয়োজন করতে পারত। এতে আওয়ামী সরকারের উদারতার রঙিন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যেত, একই সাথে হয়তোবা সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট রক্তপাতও এড়ানো যেত।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্যের বদলে প্রবল বিভাজন রয়েছে তা স্পষ্ট। স্বাধীনতার প্রশ্নে আজো আমরা এক হতে পারিনি। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আর স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি এবং ভারত কিংবা পাকিস্তানের দালাল এই বাগ্যুদ্ধের প্রতিযোগিতা দেখতে দেখতে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। একটি জনগণতান্ত্রিক দেশে জনগণের মাঝে রাজনৈতিক আদর্শ ও মতের পার্থক্য থাকবে স্বাভাবিক এবং এটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ও হুমকিস্বরূপ হিসেবে বিবেচনার সংস্কৃতি বিদ্যমান রয়েছে। অবিলম্বে এই সংস্কৃতি বন্ধ করতে না পারলে পরে ক্ষমতায় যে দল আসীন হবে তারাও একই পন্থা অবলম্বন করবে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। বাংলাদেশেও এটি বিদ্যমান রয়েছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় বাংলাদেশের পূর্বের যে-কোনো সময়ের থেকে বর্তমান সময় স্বাধীন মত প্রকাশের স্বর্ণযুগ। বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে ১৬৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বর্তমানে ৭৬তম। কিন্তু অজানা কোনো এক কারণে মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার বদলে মুখ বুজে সহ্য করার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের অতীত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি হলে, অনিয়ম-দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে গণ-আন্দোলন গড়ে উঠত, যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতৃত্বে থাকত ছাত্রসমাজ। কিন্তু বর্তমান ছাত্রসমাজ তার সোনালি অতীত ভুলে রণে ভঙ্গ দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে ভর্তি হওয়ার পর একটি সার্টিফিকেট অর্জন করে জীবিকা-নির্বাহ হয়েছে শিক্ষার্থীদের প্রধান লক্ষ্য। আর প্রিয় ক্যাম্পাসে বিচরণকালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একই ডিজাইনের টিশার্ট পরে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া, শিক্ষকদের জন্মদিনে কিংবা তাদের পদোন্নতি হলে ফুলেল শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা, রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের ন্যায্য-অন্যায্য-অনৈতিক সকল কথায় ‘সহমত ভাই’ জ্ঞাপন করার মতো মহৎ (!) কাজ করা যেন বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীদের প্রধান কর্ম। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ করা, বিশ্বায়নের সাথে শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার আনয়ন, গবেষণা বৃদ্ধি, নিয়োগ বাণিজ্য, ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম, বিভিন্ন জাতীয় সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতের বেহাল দশা, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে কথা বলা বেমালুম ভুলে গেছে। দেশের ছাত্ররাজনীতির অতীত ইতিহাস গৌরবের হলেও বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনের ছাত্ররাজনীতি পরিণত হয়েছে বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে। ছাত্রদের ন্যায্য দাবিসমূহ আদায়ের পক্ষে সোচ্চার থাকার বদলে তৈলমর্দন এবং ব্যক্তিচর্চার রাজনীতির বহুল প্রচলন ঘটেছে, বর্তমান সুবিধাবাদী ছাত্ররাজনীতিতে।
বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বৈশিষ্ট্যের অন্যতম সৌন্দর্য। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পদোন্নতি, প্রশাসনিক দায়িত্ব লাভের লিপ্সা, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায়ের প্রয়াসে কখনো গণদাবির পক্ষে নিজে অবস্থান নেন না। কারণ সরকারের বিশেষ অনুগত দূত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখার মধ্যেই চাকরি ক্ষেত্রে নিজের প্রমোশন-ডিমোশন নিহিত রয়েছে বলে তারা বিশ্বাস করেন। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের পদ পেলে যখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিজ পদবি ছেড়ে দিতে প্রস্তুত আছেন বলে ঘোষণা দেন, তখন দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মুমূর্ষু অবস্থা সম্পর্কে সহজেই স্পষ্ট অনুমান করা যায়।
বর্তমানে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে অস্থির অবস্থা বিরাজমান। বিশেষ করে রাজনীতি আমাদের দেশে অরাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে অনেক বেশি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কার্যকর বিরোধী দল দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। কিন্তু বাংলাদেশে বিরোধী দল প্রকৃত অর্থে কার্যকর ভূমিকা পালন করে কি না কিংবা করতে পারে কি না তা নিয়ে প্রায়ই পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলে। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের আন্দোলন মানেই যেন সহিংসতা। এটি নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য নয়; বরং যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বাইরে থাকে তারাই এই সংস্কৃতি চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।
উন্নত দেশসমূহে রাজনীতির প্রতি মানুষের এত ঝোঁক নেই। ক্ষমতায় কে আছে, পরবর্তীসময়ে কে যাবে তাতে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কেউ কেউ মজার ছলে বলে থাকেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদি আয়ের উৎস না থাকত, তবে রাজনীতি থেকে নব্বই ভাগ মানুষ অবসরে চলে যেত। মজার চলে বলা হলেও এটি চরম সত্য কথা। বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ করছে ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে রাজনীতিকেই ব্যবসাতে পরিণত করে ফেলেছে। দেশের কলকাঠি তাদের হাতে থাকার জন্য দেশ প্রকৃত অর্থে তাদের কাছে জিম্মি। সিন্ডিকেট করে পরিবহন খাতে ভাড়া বৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, খাদ্যে ভেজালসহ বিভিন্ন অপকর্ম নির্দ্বিধায় নির্ভয়ে সম্পন্ন করছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রায়ই তার বক্তৃতায় বলেন, ‘রাজনীতিকে ব্যবসায় পরিণত করবেন না।’ অনতিবিলম্বে এই গোষ্ঠীর বলয় থেকে দেশকে মুক্ত করতে না পারলে ক্রমাগত শুধু রক্তপাতই ঘটতে থাকবে। ‘টাকা যার, নির্বাচনে নমিনেশন ফরম তার’ এই নীতি থেকে সকল রাজনৈতিক দলকে বেরিয়ে আসতে হবে। ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে আসা রাজনৈতিক শিক্ষায় দীক্ষিত, সচ্চরিত্র, আদর্শবান ব্যক্তিকে মনোনয়ন প্রদান করতে হবে। শিক্ষিত জনপ্রতিনিধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনে আইন করে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে ন্যূনতম এইচএসসি ও স্নাতক পাস নির্ধারণ করতে হবে।
দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নাগরিকের প্রত্যাশা পূরণের অন্যতম হাতিয়ার। প্রশাসন-বিচারব্যবস্থা-সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার স্বাধীনতা প্রদান হবে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কিংবা এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সাংবিধানিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে ব্যবহারের অভিযোগ বিরোধী দলসমূহ থেকে প্রায়ই করা হয়ে থাকে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ-পদোন্নতি-পদাববনতি-বদলি সবই যদি সচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও নিয়ম মেনে করা সম্ভব হয়, তবেই কেবল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সেবা সমভাবে নিশ্চিতকরণ সম্ভব।
বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতিতে এমন অব্যবস্থাপনা/অরাজক অবস্থা যদি চলতেই থাকে, তবে একসময় প্রকৃত গণতন্ত্রের আত্মার মৃত্যু ঘটে কেবল এর দেহ জীবিত থাকবে। হরণ হবে মানুষের মৌলিক অধিকার। ব্যাহত হবে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বাভাবিক কার্যক্রমের গতি। গণতন্ত্রের মোড়কে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের প্রতিষ্ঠা হবে তাতে যে দলই বাংলাদেশের ক্ষমতার গদিতে আসীন থাকুক না কেন। মাৎস্যন্যায় পরিবেশের সৃষ্টি হওয়ার দরুণ হয়তোবা দেশীয় বা বিদেশি তৃতীয় শক্তির কুনজর পড়বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায়।
লেখক :আখতার হোসেন আজাদ
শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া