সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে ছোটবেলার শিশুতোষ কবিতাটি মনে পড়ে গেল। আবদার রশিদের ‘রাজায় রাজায়’— ...হোঁদল বলে তার চেয়ে ভাই চল না খানিক যুদ্ধ লাগাই...।
আসলে ইদানীং দেশ গরম করার মতো ইস্যু তেমন ছিল না। কিন্তু ইস্যু ছাড়া বাঙালি দিন পার করে কেমন করে! স্বাধীনতার ৫০ বর্ষপূর্তি আমাদের গৌরবের। আনন্দের সঙ্গে দেশময় উৎসবের মধ্য দিয়ে পালন করাই ছিল কাম্য। হোক তা ঘরে বসে অনলাইনে। দেশি-বিদেশি অভ্যাগত অতিথিদের নিয়ে পালন করাই তো রীতি। ব্যক্তি হিসেবে কাউকে আমাদের পছন্দ নাও হতে পারে, অভিযোগের পাহাড় থাকতে পারে। কিন্তু যখন তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি, তাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন আমাদের জাতীয় কর্তব্য। আমাদের মধ্যে যতই বিভেদ থাকুক, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অন্য দেশে গিয়ে যথাযথ সম্মান না পেলে আমাদের কেমন লাগবে? এই বোধটুকু থাকা উচিত ছিল।
হেফাজতের বিক্ষোভ এবং তৎপরবর্তী ঘটনাবলিতে প্রাণহানি আমাদের জাতীয় লজ্জা। আগে কে গুলি করেছে, ভাঙচুর শুরু করেছে, সেসব তদন্তের বিষয়। তবে যারাই শুরু করুক কিংবা উসকানি দিক, তা সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বের করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। অবশ্য ‘সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত’ বিষয়টিতে জনমনে যথেষ্ট সংশয় রয়ে গেছে।
আমাদের ঘরোয়া রাজনীতিতে বিভাজন নাঙ্গা চোখে দেখা যায়। কোনো জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমাদের জাতীয় ঐক্য হয়েছে বা হয়েছিল, তা বোধ হয় শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বর্ষপূর্তিতে সকলে দল-মত-পথের ঊর্ধ্বে উঠে মিলেমিশে পালন করবে, এটা খুব দুরাশা ছিল না। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট তা আরো দূর অস্তই করে দেখিয়েছে।
আমরা জন্ম নেই হিন্দু-মুসলিম ঘরে, আমরা জন্ম নেই আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াতের ঘরে! তারপর বড় হই একে অপরের প্রতি ঘৃণা নিয়ে বুকে। শিশুমনেই বুনে দিই হিংসার বীজ। হিন্দুর পূজা, মুসলমানের ঈদে শিশুদের যেতে, আনন্দ করতে বাধা কোথায়! কিন্তু না! অবাধ এই মেলামেশায় বাধা বড়রাই। কেউ বঙ্গবন্ধুকে নেতা মেনে বড় হয়, কেউবা তাকে অন্যের চেয়ে ছোট করে মজা পায়। আবার কেউ অন্যদের কাফের বলে ফতোয়া দেয়। কেউই ভাবে না যে, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, হেফাজত-সব এ মাটিরই সন্তান, কেউ ভিন গ্রহ থেকে এখানে আসেনি।
সবচেয়ে বিস্ময়কর যে সবাই কিন্তু কোনো না কোনোভাবে একে অপরের সঙ্গে জড়িত। কেউ রক্তের বন্ধনে, কেউবা পড়শি। রাজনৈতিক বিভাজনটা এতটাই তীব্র যে রক্তের বন্ধনও সেখানে তুচ্ছ। দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে দেখেছি এর বীভৎস রূপ। রাজশাহীর দুর্গাপুরের পাশাপাশি দুটি গ্রামের করুণ দৃশ্য দেখেছি ১৯৯৮ সালে। একটি গ্রাম আওয়ামীপন্থি, অন্যটি বিএনপি। এক গ্রামের সকল জমির ফসল মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে অন্য পক্ষ। প্রতিশোধস্বরূপ তারা আবার প্রতিপক্ষের বাড়িঘর কচুকাটা কেটেছে। কোনো ঘরই আস্ত ছিল না। কিছুদিন আগেই নির্বাচনের দিন আপন দুই ভাইয়ের এক ভাই আরেক ভাইকে খুন করেছে শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণে। একই কলেজে একই শ্রেণিতে পড়ালেখারত অবস্থায় একদল আরেক দলের ওপর হকিস্টিক, রড, রামদা নিয়ে হামলে পড়তে দেখেছি শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণে। ৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি গোলাগুলি, একজনের মাথার পেছনে পিস্তল ঠেকিয়ে তাড়া করে ফেরা মেধাবী ছাত্রকে, তাও শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণে।
এই বিভাজন একদিনে গড়ে ওঠেনি। দিনে দিনে বাড়তে বাড়তে এ পর্যায়ে এসেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তারাই দেশটাকে তাদের সম্পত্তি বানিয়ে ব্যবহার করেছে। জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে অন্যদের মতামত কিংবা গুরুত্ব না থাকায় জনগণের একাংশের মধ্যে আপন করে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। ফলে বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতাই হয়ে ওঠে মুখ্য। জাতীয় পর্যায়ে সহিষ্ণুতা, সংহতি আস্তে আস্তে লোপ পেতে থাকে। কথায় কথায় অন্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যকে অধিকার থেকে বঞ্ছিত করা একটি স্বাভাবিক চর্চায় পরিণত হয়েছে। সেইসঙ্গে তৈরি হয়েছে একটি মোসাহেবি গোষ্ঠী।
নির্বাচনের আগপর্যন্ত যার যার দলের, নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিনিধি সকলের। দল-মত নির্বিশেষে সকলের উন্নতির স্বার্থে সেবা করা, কাজ করে যাওয়াই জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব। আমরা কী তা পারছি? জনগণ, জনসেবা যেখানে মুখ্য, দল সেখানে গৌণ। কিন্তু আমাদের কাছে দলবাজিই এখন মুখ্য। এমনকি জনগণের সেবক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও এর প্রভাব প্রবল। আর প্রতিটা শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে যখন বিভেদের দেয়াল ওঠে, সেখানে জাতীয় স্বার্থ বলে কিছু থাকে না। তখন একদল ভালো কিছু করলেও বা করতে চাইলেও অন্যদের দ্বারা প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়। জাতীয় স্বার্থের চাইতে তখন ব্যক্তি, দল বড় হয়ে দেখা দেয়।
দল, মত, পথের ঊর্ধ্বে উঠে জাতি এবং জাতীয়তাবোধ গড়ে না ওঠা পর্যন্ত কোনো দেশ উন্নত হতে পারে না, সম্ভব নয়। সে আমরা যতই গর্ব করি না কেন! বাংলাদেশের সমসাময়িক দেশগুলো তার প্রমাণ। অনেক দেশই আছে, যাদের উন্নত দেশ হতে ৫০ বছর লাগেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অপমানজনক চুক্তি, ঋণের ভারে জর্জরিত জার্মানি মাত্র নয় বছরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ বাধাতে সক্ষম হয়েছিল। এখানে তার পুনর্গঠনকে আমরা পজিটিভ দিক ধরে নিতে পারি যার মূলে ছিল জাতীয়তাবাদ চেতনা। আর যুদ্ধটা ছিল অদূরদর্শী নেতৃত্ব।
গত ৪০ বছরে ভিয়েতনাম প্রায় সব দিক থেকে বাংলাদেশের ওপরে অবস্থান করছে। মালয়েশিয়া সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বলছে, গত ৫০ বছরে উচ্চ আয়ের দেশ এবং উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছে। এশীয় দেশ, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় আমরা ধীর গতির উন্নয়নে আছি। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের উন্নতি বেশ লক্ষণীয়। আমরা ধীরে ধীরে নিম্ন আয়ের দেশ হতে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছি। প্রায় সবগুলো প্যারামিটারে প্রতিবেশী দেশ থেকে এগিয়ে আছি। এটা শুভ লক্ষণ। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এই প্রাপ্তি আমাদের ভবিষ্যতের পথচলার প্রেরণা।
তবে এসব এমনিতেই আসেনি। গতিশীল নেতৃত্ব আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এর নিয়ামক। শেষোক্তটি সম্পূর্ণরূপে না হলেও প্রথমটি স্বীকার করতে হবে। রাজনৈতিক সামাজিক ঝড়-ঝাপটা যতই আসুক—উৎপাদন, রপ্তানি-আমদানিতে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব পড়তে না দেওয়াটা নিঃসন্দেহে দূরদর্শী নেতৃত্বের পরিচয়। আর এসব দিক থেকে বাংলাদেশ সঠিক পথেই আছে বলে বিশ্বাস।
‘সুখে থাকতে ভূতে কিলায়’ প্রবাদটি যেন আমাদের জন্য শতভাগ প্রযোজ্য। ‘কাজ নেই তো খই ভাজে’র মতো অহেতুক আমরা ইস্যু তৈরি করি। এখন ‘সুখে থাকতে ভূতে যদি না কিলায়’ তাহলে আমাদের এই উন্নয়নের সঠিক ট্র্যাকটিকে ধরে থাকতে হবে। নিত্যনতুন ইস্যু সৃষ্টি করে অস্থিরতা তৈরি না করে সকলকে একযোগে দেশের উন্নয়নে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যেতে হবে। অবশ্য দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা উন্নয়নকে নিম্নগামী করে, এটা সত্য। তবে মার্কিন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রস্ট্রো যেমনটা বলেছিলেন, ‘উন্নয়ন হতে গেলে কিছু দুর্নীতি থাকবে এবং তা মেনে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’ তবে তা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখাটা একার পক্ষে সম্ভব নয়, দরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
উন্নয়নের স্বাদ সবাইকে দিতে হলে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। সবাই কাজে ব্যাপৃত হলে অযথা উদ্ভট ইস্যু তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসবে। দেশ নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারবে। মানুষের মধ্যে অহেতুক রাজনৈতিক বিবাদ, বিভেদ কমে আসবে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িও কমে আসবে। ভাবতে হবে আগে ব্যক্তি নয়, দল নয়; আগে দেশ। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, হেফাজত হয়ে নয়, বাংলা মায়ের সন্তান হিসেবে একে অপরের হাত ধরাধরি করে আমরা এদেশকে নিয়ে যেতে পারব উন্নতির শিখরে।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক