ফিচার

উত্তর-উপনিবেশবাদ ও রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘ ও রৌদ্র’

  • প্রকাশিত ৪ অগাস্ট, ২০১৮

মাসুদুজ্জামান

বাংলা ছোটগল্পের স্রষ্টা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সাফল্য বিস্ময়কর। কিন্তু আরো বিস্ময়কর হচ্ছে তার গল্পে এমনসব বিষয় উপজীব্য হয়েছে, যা এই একবিংশ শতাব্দীর একেবারে সাম্প্রতিকতম প্রসঙ্গকেও ছুঁয়ে যায়। উত্তর-উপনিবেশবাদ এ রকমই একটি বিষয়, যে বিষয়কে রবীন্দ্রনাথ তার কালেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং তা তার সৃজনীপ্রতিভার স্পর্শে মূর্ত করে তুলেছিলেন।

কী প্রাচ্য কী প্রতীচ্য সাম্প্রতিককালে সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে ‘উত্তর-উপনিবেশবাদ’ তত্ত্বটি ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। ইংরেজি পোস্টকলোনিয়ালিজম শব্দের বাংলা হচ্ছে এটি। বলা বাহুল্য, ‘উপনিবেশবাদ’ শব্দটি রাজনৈতিক পরিভাষা হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে বাংলা ভাষায় প্রচলিত রয়েছে। এই পারিভাষিক শব্দটি বিভাজন করলে সহজেই বোঝা যায় উপনিবেশের আগে ‘উত্তর’ বা কলোনিয়ালিজমের আগে ‘পোস্ট’ শব্দাংশটি জুড়ে দিয়ে এই উত্তর-উপনিবেশবাদ (বা পোস্টকলোনিয়ালিজম) শব্দটি তৈরি করা হয়েছে। উৎসের দিক থেকে উপনিবেশ থেকে তাই উত্তর-উপনিবেশবাদ শব্দটির সৃষ্টি। দীর্ঘকাল ধরে উপনিবেশের অধীনে থাকা দেশগুলো যখন স্বাধীনতা লাভ করে, স্বশাসনের সুযোগ পায়, স্বাধীন সেই সময়পর্বকেই উত্তর-ঔপনিবেশিক কাল বলা হয়। উপনিবেশবাদের মতো উত্তর-উপনিবেশবাদ শব্দটির রাজনৈতিক তাৎপর্যই প্রধান। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে স্বাধীনতাকামী জনগণের সংঘাতই হচ্ছে এই রাজনীতির মূল কথা। ঔপনিবেশিক শক্তি আসলে দেশে দেশে এমনভাবে উপনিবেশ স্থাপন করেছে যে, তারা সামাজিক সাংস্কৃতিক ধর্মীয় রাজনৈতিক সবদিক থেকেই উপনিবেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। যেসব দেশে উপনিবেশ স্থাপন করা হয়েছে, হয় তাদের স্বকীয়তাকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে দিতে চেয়েছে কিংবা বিকৃত করে দিয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সবদিক থেকে ভারতীয়দের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। রবীন্দ্রনাথের বেশকিছু গল্পে, বিশেষ করে ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে উপনিবেশের এরকম আধিপত্যবাদী চেহারাই আমরা উপস্থিত দেখি।

উল্লেখ্য, তৃতীয় বিশ্ব আর তৃতীয় বিশ্বের লেখকরাই হচ্ছে উত্তর-উপনিবেশবাদী সাহিত্যের রচয়িতা। ফলে এই সাহিত্যের মধ্যে তৃতীয় বিশ্বের সাম্প্রতিক বিচিত্র পরিস্থিতি, যেমন জাতিগোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব, দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নারীর প্রতি সহিংসতা, রাজনৈতিক সংঘাত, বৈদেশিক ঋণের বোঝা, স্বৈরাচার ও সামরিক শাসনের মতো বহুমুখী সঙ্কটের প্রতিফলন লক্ষ করা যাবে। এসব সঙ্কট, অনেকেই মনে করেন ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থারই ফল। এই প্রেক্ষাপটেই বলা যায়, সমকালীন সাহিত্যকে বোঝার জন্য উত্তর-উপনিবেশবাদের তাই কোনো বিকল্প নেই। এই তত্ত্বটি হচ্ছে ওয়াল্ডারের ভাষায় সমকালীন ‘ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন বোঝার মাপকাঠি’। উত্তর-উপনিবেশবাদী সাহিত্যতত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা মূলত এখানেই। এভাবে বিবেচনা করলে উত্তর-উপনিবেশবাদ মানবিক সম্পর্ককে দেখার নতুন পথ খুলে দিয়েছে। কথাটা বলেছিলেন এডওয়ার্ড সাঈদ তার ‘ইমপেরিয়ালিজম অ্যান্ড কালচার’ গ্রন্থে— ঔপনিবেশিক কালেই উপনিবেশের বিরোধিতা করে দেশীয় লেখকরা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। সাঈদ এই প্রবণতাকে চিহ্নিত করেন ‘প্রতিরোধের সাহিত্য’ বলে। পরে এই প্রবণতার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন এলিয়েকে বোহেমার তার ‘কলোনিয়াল অ্যান্ড পোস্টকলোনিয়াল লিটেরেচার’ গ্রন্থে। বিল অ্যাশক্রফ্ট, গ্যারেথ গ্রিফিথ, হেলেন টিফফিন, রবার্ট জে সি ইয়ং ও নিকোলাস হ্যারিসনের লেখায়ও এর বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। প্রতিরোধের এই সাহিত্য, তাদের মতে, উত্তর-উপনিবেশবাদী সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথও এভাবেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির মুখোমুখি হয়েছেন। গড়ে তুলেছেন প্রাচ্যবাদবিরোধী উত্তর-উপনিবেশবাদী ডিসকোর্স। ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পটিকে এরকমই একটি ডিসকোর্স হিসেবে উপস্থিত হতে দেখি আমরা।

ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণে আক্রান্ত ভারতীয় গ্রামসমাজের চেহারা সেদিন যে কী দাঁড়িয়েছিল, গল্পের প্রায় শুরুতেই তার বর্ণনা আছে : ‘গ্রামের মধ্যে আর সকলেই দলাদলি, চক্রান্ত, ইক্ষুর চাষ, মিথ্যা মকদ্দমা এবং পাটের কারবার লইয়া থাকিত, ভাবের আলোচনা এবং সাহিত্যচর্চা করিত কেবল শশিভূষণ আর গিরিবালা।’ এই বর্ণনার মধ্যে ভারতীয় সমাজ যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, তার উল্লেখ পাই। সেই সঙ্গে খণ্ডিত আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শশিভূষণের মতো বুর্জোয়া-মানবতাবাদী, সুকুমার মনের সংবেদনশীল চরিত্রেরও যে সৃষ্টি হচ্ছে, তার ইঙ্গিত মেলে। প্রকৃতপক্ষে মানবতাবাদী শশিভূষণের সঙ্গে ক্ষমতামদমত্ত ইংরেজদের সংঘাতকে কেন্দ্র করে ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে।

মিশেল ফুকো বলেছিলেন, ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্যে আধিপত্যবাদী ডিসকোর্সের জন্ম দেয়। নিজেদের মতো আইনি ব্যবস্থা, পুলিশ ও কারাগার সৃষ্টি করে দ্রোহী মানুষের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে। চার দেয়ালের ভেতর প্রতিবাদী সাধারণ মানুষকে আটকে রেখে তাদের শাসন-শোষণকে অব্যাহত রাখে। সাঈদ আবার ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় দেখেছেন নেটিভদের জন্যে আচরণের সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে আধিপত্যের এই চেহারা অত্যন্ত স্পষ্ট করেই ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ।

‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পের নায়ক শশিভূষণ। লক্ষণীয়, পাশ্চাত্যশিক্ষায় আলোকিত শশিভূষণ ঔপনিবেশিক শাসকের সঙ্গে যুক্ত তিন ক্ষমতাধর ব্যক্তি, বর্গ বা শ্রেণিপ্রতিনিধি- ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, স্টিমারের ইংরেজ ম্যানেজার আর ইংরেজ পুলিশের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েও পরাজিত হয়। গল্পের ম্যাজিস্ট্রেটের কথাই ধরা যাক। তার দাপট এমন যে, নিজের মেথরের অপমানও তিনি সহ্য করতে পারেননি। শুধু ম্যাজিস্ট্রেট নন, নতুন বাণিজ্যপুঁজির প্রভাবে উপনিবেশের জলপথে আসা স্টিমারের ইংরেজ ম্যানেজার ‘দিশি পালের প্রতিযোগিতা’, অর্থাৎ নেটিভদের অযান্ত্রিক প্রতিযোগিতার প্রাধান্য বা ঔদ্ধত্য সহ্য করেননি। বন্দুক দিয়ে নেটিভের যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেছেন, তাদের অদৃশ্য করে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শক্তির ক্ষমতার চেহারাটাকে যে কত সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে দেখেছিলেন ও অনুভব করেছিলেন, এই গল্পটি পড়লেই তা বোঝা যায়।

প্রথমেই লক্ষণীয়, নৌকাটি ছিল মহাজনের নৌকা, অর্থাৎ ভারতীয়দের মধ্যে অনেকেই সেদিন ব্যবসা-বাণিজ্যে উদ্যোগী হয়েছিল। কিন্তু এই নৌকাটি ছিল অযান্ত্রিক, অর্থাৎ দেশীয় প্রযুক্তির দ্বারা তৈরি। পক্ষান্তরে স্টিমারটি ছিল যান্ত্রিক, পশ্চিমা যন্ত্রসভ্যতার দম্ভের প্রতীক, প্রাচ্যের তুলনায় পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। যন্ত্র, জ্ঞান ও সামরিক শক্তির বলে বলিয়ান অধিক ক্ষমতাধর ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতিনিধি স্টিমারের ইংরেজ ‘ম্যানেজার সাহেব’ তাই নেটিভের ঔদ্ধত্যকে সহ্য করতে পারেনি। নৌকাটি স্টিমারকে হাতদুয়েক ছাড়িয়ে যেতেই তিনি তার পূর্ণ ক্ষমতার প্রকাশ দেখালেন। আরেক যন্ত্র (আগ্নেয়াস্ত্র) বন্দুক দিয়ে ‘স্ফীত পালকে লক্ষ্য’ করে গুলি চালালেন। ‘এক মুহূর্তে পাল ফাটিয়া গেল’— এই বর্ণনাও গভীর অর্থ বহন করছে। ‘এক মুহূর্ত’, অর্থাৎ খুব সহজেই ঔপনিবেশিক শক্তি উপনিবেশের অধীন মানুষকে পদানত করতে পারত। নৌকাটা ডুবিয়ে দিয়ে ইংরেজ ম্যানেজার যে নেটিভদের সব প্রতিরোধ একেবারে চূর্ণ করে দিলেন, সে কথাই জানালেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু লেখক-ভাবুক রবীন্দ্রনাথ, নেটিভদের যিনি প্রতিনিধি, এই পরাজয় সহজে মেনে নিতে পারেননি। শশিভূষণ নির্যাতিতের পাশে এসে দাঁড়ালেন। আসলে শশিভূষণ হচ্ছেন সাঈদ-কথিত উপনিবেশের সেই মানুষ, যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন, সংবেদনশীল। ফলে তিনি নির্যাতিতের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছেন। ইংরেজের অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। এই প্রতিবাদ শশিভূষণ করেছেন দুইভাবে : মৌখিকভাবে এবং আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে।

প্রথম আইনি লড়াই শশিভূষণ করেন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় আইনি লড়াই শশী করেন অল্পবয়স্ক ‘ইংরাজনন্দন’ স্টিমারের ম্যানেজারের বিরুদ্ধে। মাঝিদের পক্ষ হয়ে মামলা লড়েন শশী। ঔপনিবেশিক শক্তির ক্ষমতার দম্ভ যে কতটা ‘হিংস্র’ আর ‘পৈশাচিক’ হয়ে উঠেছিল, সে সবেরও উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। শুধু তা-ই নয়, এ ঘটনার পরও ঔপনিবেশিক হিংস্র শক্তি এবং নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারকারী ইংরেজ ম্যানেজারের যে শাস্তি হবে না, তারও উল্লেখ আছে এই গল্পে। প্রকৃতপক্ষে ঘটেছেও তা-ই, আইনের মারপ্যাঁচে ঔপনিবেশিক শাসকদের ষড়যন্ত্রের কারণে দেশীয় মানুষই শাস্তি পেয়েছে। তৃতীয়বার শশী আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন খোদ আইনের রক্ষক ঔপনিবেশিক শক্তির সামরিক প্রতিনিধি পুলিশের বিরুদ্ধে। কিন্তু পুলিশের বড় কর্তাকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করার কারণে শশীকে পুলিশের হাতে মার খেতে হয়, হাজতে যেতে হয় এবং পাঁচ বছরের জেল হয়।

আইনি লড়াইয়ের ধারাক্রম লক্ষ করলে দেখা যাবে, শশিভূষণ দুবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অত্যাচারিত ভারতীয়দের পক্ষে মামলা লড়েছেন। কিন্তু তৃতীয়বার তার বিরুদ্ধেই মামলা হয়। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো হরকুমারের অপমান, মহাজনি নৌকার পাল ফুটো করে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া, জেলেদের জাল কেটে দেওয়া, এসব অন্যায়ের কোনো সুবিচার হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আইনের কাছে শশিভূষণ অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিকার চাইলেও আইনই তাকে ফাঁসিয়ে দেয়। ঔপনিবেশিক শাসকদের আইন যে কতটা নিষ্ঠুর অর্থহীন অমানবিক ছিল, শশী নিজেও বারবার তা উপলব্ধি করেছেন। ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পেও ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসক তার শাসন-ক্ষমতাকে সুসংহত আর নিষ্কণ্টক রাখার জন্যে নিজেদের প্রবর্তিত সমগ্র আইনি ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেছেন। তাকে জেলে ঢুকিয়ে তার প্রতিরোধের ক্ষমতাকে চূর্ণ করে দিয়েছেন। উপনিবেশবাদের জটিলকূটিল রূপটি এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বেশ স্পষ্ট হয়ে যায়। শশিভূষণ ছিলেন আসলে শান্তিপ্রিয় ভারতীয়তার প্রতীক, ইউরোপীয় মানবতাবাদে যার চেতনা পরিশ্রুত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আইনি কারণে তাকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক বর্বরতার কাছে পরাভব মানতে হয়। বলা বাহুল্য, একে এডওয়ার্ড সাঈদ যেমন বলেছেন, প্রাচ্যবাদের আরেক ধরনের প্রকাশ বলা যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে শাসিত মানুষের দ্বান্দ্বিক রূপকে ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তার মধ্য দিয়েও আমরা উপনিবেশবাদের চমৎকার ছবি পাই। ইংরেজ চরিত্র ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপার ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, স্টিমারের ইংরেজ ম্যানেজার ঔপনিবেশিক বাণিজ্যপুঁজির। দেশীয় মানুষজন উপনিবেশবাদের ভাষায় নেটিভদের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে শশিভূষণ ছিলেন ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও সন্দীপনচেতনার (এনলাইটেনমেন্ট) দ্বারা বিভাবিত নতুন কালের শিক্ষিত ভারতীয়দের প্রতিনিধি। এই গল্পের দ্বান্দ্বিক ব্যাপারটি ঘটে শশিভূষণের সঙ্গে ইংরেজ শাসকদের; অর্থাৎ ইউরোপীয় নবজাগরণবাদের ‘নেটিভ’ প্রতিনিধির সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসকদের। রবীন্দ্রনাথ উপনিবেশবাদের আধিপত্যবাদী পদ্ধতি আর তার চেহারাটি যে কতটা সুনির্দিষ্ট আর সুসংহত ছিল, এই গল্পে তা ফুটিয়ে তুলেছেন। লক্ষণীয়, ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকরা ছিলেন ভারতীয়দের মা-বাপ, অর্থাৎ অভিভাবক, প্রভু। এই প্রভুই তার ইচ্ছামতো ভারতীয়দের নিয়ে যা খুশি করতে পারতেন, কিন্তু দেশীয় ভারতীয়দের করার কিছু ছিল না, করা যেত না। ‘স্টিমারের অল্পবয়স্ক ম্যানেজার সাহেব’ (ইংরেজ) ‘দিশি পালের’ নৌকার পাল গুলি করে ফুটো করে নৌকাটা ডুবিয়ে দিয়ে সে কথা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ইউরোপীয় যন্ত্রসভ্যতা আর দেশীয় প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় নেটিভ বা দেশীয়রা জয়ী হবেন আর ঔপনিবেশিক শক্তি হেরে যাবে, এটা ম্যানেজারের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পের মূল তাৎপর্য মূলত এইখানেই।

রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের রাষ্ট্রিক-সামাজিক-সামরিক ক্ষমতার বিন্যাসটি কেমন ছিল, সেটাই ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে উপজীব্য করে তুলতে চেয়েছেন। গল্পটির অভ্যন্তরীণ ঘটনাপুঞ্জ থেকে বোঝা যায় ঔপনিবেশিক কালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রে ছিলেন বহিরাগত ইংরেজ শাসক ও বণিক শ্রেণি, আর তাদের সহায়তা করেছেন ইংরেজের দ্বারাই সুবিধাভোগী দেশীয় ধনী জমিদার-নায়েব শ্রেণি। সাধারণ ভারতীয় বা দেশীয়দের অবস্থান ছিল প্রান্তে। তারা ছিলেন প্রকৃতপক্ষে সমকালের নিম্নবর্গের অন্তর্গত মানুষ। উল্লিখিত প্রথম শ্রেণি, অর্থাৎ ঔপনিবেশিক ইংরেজরা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, দেশীয় জমিদার-নায়েবরা তাদের সহায়তা করে এই ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগ করেছেন। এই দুই শ্রেণির দ্বারাই রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে শোষিত হয়েছেন দরিদ্র নিম্নবর্গের অন্তর্গত দেশীয় ভারতীয়রা। শশী এই শেষোক্ত নিম্নবর্গের মানুষের পক্ষেই দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি আধুনিক মানুষের মতোই নির্জনতাপ্রিয়; কিন্তু ব্যক্তিঅপমান, বিশেষ করে কোনো ভারতীয় অপমানিত নির্যাতিত হলে ব্রিটিশের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছেন। এদিক থেকে শশীকে নিশ্চিতভাবে উনিশ শতকের ইউরোপীয় সভ্যতার দ্বারা বিভাবিত চরিত্র বলে উল্লেখ করা যায় আর এই গল্পের ইংরেজদের চিহ্নিত করা যায় ঔপনিবেশিক আধিপত্যকামী শক্তি হিসেবে। বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের ধারায় এই গল্পটি তাই নিঃসন্দেহে প্রথম উত্তর-উপনিবেশবাদী গল্প হিসেবে অনন্য হয়ে থাকবে।  ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads