মুফতি নূর মোহাম্মদ রাহমানী
ইসলামের দৃষ্টিতে ইমামতি একটি মহান দায়িত্ব। সুন্দর ও সম্মানজনক পদ। আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) নিজে ইমামতি করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম এই মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের পরবর্তী মুসলমানদের সর্বোত্তম পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ সমাজের ইমামতি করেছেন। নবী করিম (সা.) ইমামের মর্যাদাকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সাথে সাথে এই মহান দায়িত্ব পালনে ইমামদের সতর্কও করেছেন। বিভিন্ন হাদিসে তাদের অনেক ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে।
ইমামের জন্য নবীজির (সা.) দোয়া
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মসজিদের ইমাম হলো মুসল্লিদের জন্য জিম্মাদার এবং মুয়াজ্জিন আমানাতদারস্বরূপ। হে আল্লাহ, তুমি ইমামদের সৎপথ প্রদর্শন কর এবং মুয়াজ্জিনদের ক্ষমা কর।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০৭)
সঠিক সময়ে নামাজ পড়ানোর সওয়াব
উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি সঠিক সময়ে লোকদের নিয়ে জামাতে নামাজ আদায় করছে, এজন্য সে (ইমাম) নিজে ও মুকতাদিগণও পরিপূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবে। অপরপক্ষে যদি কোনো সময় ইমাম সঠিক সময়ে নামাজ আদায় না করে তবে এজন্য সে দায়ী হবে কিন্তু মুকতাদিগণ পরিপূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫৮০)
ইমাম মিশকের স্তূপের ওপর থাকবে
হাদিস শরিফে এসেছে, তিন ব্যক্তি মিশকের স্তূপের ওপর থাকবে। হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, তিন ব্যক্তি কিয়ামতের দিন মিশকের কস্তুরির স্তূপের ওপর থাকবে- ১. যে ক্রীতদাস আল্লাহ ও তার প্রভুর হক ঠিকমতো আদায় করে। ২. যে ব্যক্তি কোনো কওমের ইমামতি করে আর তারা তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং ৩. যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য প্রত্যেক দিন ও রাতে আজান দেয়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৮৬)। কিয়ামতের দিন উল্লিখিত তিন শ্রেণির লোককে মিশকের স্তূপে আল্লাহ এ জন্য রাখবেন যে, এরা দুনিয়ার জীবনে নিজেদের কামনা-বাসনাকে পরিত্যাগ করে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসুলের (সা.) নির্দেশনাগুলোকে মাথা পেতে নিয়েছিল। এজন্য মহান আল্লাহ বিনিময়ে তাদের খোশবুর আকৃতিতে বিরাট প্রতিদান দেবেন যাতে অন্যান্য লোকদের ওপর তাদের মর্যাদা প্রমাণিত হয়।
নামাজ সংক্ষিপ্ত করা
ইমামের মূল দায়িত্ব হলো, নামাজ পড়ানো। এজন্য নামাজের যাবতীয় দিক খেয়াল রাখা একজন ইমামের জন্য অবশ্য কর্তব্য। তন্মধ্যে একটি হলো, জামাতের নামাজ সংক্ষিপ্ত করা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত- নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ লোকদের ইমামতি করলে সে যেন (নামাজ) সংক্ষেপ করে। কেননা তাদের মধ্যে ছোট বালক, দুর্বল ও অসুস্থ লোক থাকতে পারে। যখন সে একাকী নামাজ আদায় করে, তখন নিজ ইচ্ছামতো (দীর্ঘ করে) আদায় করতে পারে।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩৬)
প্রাকৃতিক প্রয়োজনের বেগ নিয়ে নামাজে না দাঁড়ানো
হজরত সাওবান (রা.) হতে বর্ণিত- হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘প্রাকৃতিক প্রয়োজনের বেগ নিয়ে কেউ যেন নামাজে না দাঁড়ায়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৭)
কাতার সোজার হওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ
কাতার ঠিক করা ওয়াজিব। এটি নামাজ পরিপূর্ণ করার অন্তর্ভুক্ত। ইমাম সাহেবের বিষয়টি খেয়াল করতে হবে। ওমর (রা.) হতে বর্ণিত আছে- তিনি কাতার ঠিক করার জন্য একজন লোক নিযুক্ত করতেন। যে পর্যন্ত না তাকে জানানো না হতো যে, কাতার সোজা হয়েছে সে পর্যন্ত তিনি তাকবির (তাহরিমা) বলতেন না। ওসমান এবং আলী (রা.) এদিকে তীক্ষ্ন নজর রাখতেন এবং তারা বলতেন, তোমরা সোজা হও। আলী (রা.) তো নাম ধরেই বলতেন, অমুক একটু আগাও, অমুক একটু পিছাও।’ (তিরমিজি : ১/৩০২)।
মুসল্লিদের অসন্তুষ্টি নিয়ে ইমামতি না করা
আমর ইবনে হারেস ইবনে মুস্তালিক (রহ.) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘কথিত আছে, দুই ব্যক্তির ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ শাস্তি হবে : যে নারী তার স্বামীর অবাধ্যচরণ করে এবং কোনো গোত্রের ইমাম যাকে তারা অপছন্দ করে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৯)
ইমাম মুসল্লিদের প্রতিনিধি
ইমাম তার অধীন লোকদের পক্ষ থেকে আল্লাহর দরবারে প্রতিনিধিত্ব করেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের মধ্যকার উত্তম ব্যক্তিকে তোমাদের ইমাম নিয়োগ করবে। কারণ তিনি হবেন তোমাদের পক্ষে তোমাদের প্রতিপালকের প্রতিনিধি।’ (দারাকুতনি, হাদিসদ : ১৮৮১)
ইমাম দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত- রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো কওমের ইমাম নিযুক্ত হয়, সে যেন আল্লাহকে ভয় করে এবং জেনে রাখে যে, সে তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। যদি সে তার দায়িত্ব সুচারুরূপে আঞ্জাম দেয়, তবে তার পশ্চাদ্বর্তী মুসল্লির সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে। কিন্তু তাদের সওয়াব সামান্যও কম করা হবে না। তবে নামাজে যদি কোনো ত্রুটি হয়, তবে তার দায়িত্ব তারই।’ (আল মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৭৭৫৫)
মুসল্লিদের খোঁজ-খবর নেওয়া
মুসল্লিদের খোঁজ-খবর নেওয়া একজন আদর্শ ইমামের কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে খুব চমৎকার বলা হয়েছে হাদিস শরিফে। হজরত আবু সুলাইমান মালেক ইবনে হুয়াইরিস (রা.) বলেন, ‘আমরা কয়েকজন সমবয়সি যুবক নবী করিম (সা.)-এর খেদমতে হাজির হলাম এবং বিশ দিন পর্যন্ত তাঁর খেদমতে থাকলাম। তিনি যখন অনুভব করলেন যে, আমরা ঘরে ফিরতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছি, তখন তিনি আমাদের বাড়ির লোকজন সম্পর্কে আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন। আমরা নিজ বাড়ির অবস্থা তাঁর কাছে বর্ণনা করলাম। তিনি অত্যন্ত কোমল হূদয় ও দয়ালু ছিলেন। বললেন, আচ্ছা, এবার তোমরা নিজেদের পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যাও! তাদেরকে গিয়ে (এখানে যা শিখে গেলে তা) শেখাও এবং সৎকাজে আদেশ কর এবং আমাকে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখলে, সেরূপ নামাজ পড়। যখন নামাজের সময় হবে, তখন তোমাদের মধ্যে একজন উঠে আজান দেবে এবং তোমাদের মধ্যে যে সবার বড়, সে ইমামতি করবে।’ (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ২১৩)। আর শুধু নামাজ পড়ালেই হবে না; বরং মুসল্লিদের নামাজ শুদ্ধ হচ্ছে কি না খেয়াল রাখতে হবে। যারা নামাজ পড়ে না, তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে মসজিদে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। নবীজি (সা.) তো হাটে-বাজারে, অলিতে-গলিতে, বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ঘুরে মানুষকে নামাজের দাওয়াত দিয়েছেন। আল্লাহর দিকে ডেকেছেন। তাহলে ইমামদের এতে লজ্জা হবে কেন? আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, ইমামের জন্য ফরজের আগে-পরের সুন্নত নামাজের প্রতি বিন্দুমাত্র অমনোযোগিতা খুবই দৃষ্টিকটু। এটা মুসল্লিদের ওপর প্রভাব পড়ে। তাই একজন ইমামের জন্য শুধু সুন্নতে মুয়াক্কাদা নয়; বরং নফলের প্রতিও গুরুত্বারোপ করা উচিত।
মসজিদের ইমাম সমাজেরও ইমাম
ইমামতি সাধারণ কোনো পেশা নয়। এর রয়েছে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য। সেবার মানসিকতা নিয়েই এ পেশায় আত্মনিয়োগ করা উচিত। একজন ইমাম শুধু মসজিদের ইমাম নন; বরং তিনি সমাজেরও ইমাম। মানুষ, মনুষ্যত্ব ও সমাজ নিয়েও একজন নবীর উত্তরাধিকারী ইমামকে ভাবতে হবে। একজন ইমাম হতে পারেন মানবতার পথপ্রদর্শক। ইমাম বোধসম্পন্ন হলে, তার সংশ্রবে থেকে মুসল্লিরা ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মিতার গুণ শেখে। একজন ইমামই পারেন দিগ্ভ্রান্ত মানুষকে সরল পথে পরিচালিত করতে। আল্লাহর সত্তার সঙ্গে মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিতে। ইমামকে সকলের আস্থাভাজন হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেন সকলে নিজের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, জাগতিক ও ধর্মীয় সব বিষয়ে মতের আদান-প্রদান করতে পারেন। লেনদেন, বিয়ে-শাদি ও অন্যান্য কার্যক্রমে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নির্বাচন করতে পারেন। বেতন-ভাতা প্রসঙ্গ : বর্তমান সময়ে বাজারের অবস্থা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। তা ছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থাও অনেক ব্যয়বহুল। তাই একজন ইমামের সম্মানজনক বেতন-ভাতা ধার্য করা, তাঁর জীবন-যাপনের স্তরকে ওপরে উঠানো উচিত, যাতে করে বিনা টেনশনে তিনি একাগ্রতার সঙ্গে দিনের খেদমত আঞ্জাম দিতে পারেন।
লেখক : মুফতি ও মোহাদ্দিস
জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত
চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ