মানুষের প্রাচীন ইতিহাসে দেখা যায় সভ্যতার শুরুতে পরিবারের প্রধান কর্তাই ছিলেন নারী। সে সময় পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা অনেক কম ছিল। টিকে থাকা ও শিকারের সুবিধার জন্য জনসংখ্যা বাড়ানো অতি জরুরি হয়ে পড়ে। নারীরা যেহেতু সন্তান জন্ম দিত সেহেতু সমাজেও নারীরা লৈঙ্গিক প্রাধান্য বিস্তার করে। তাদের এ প্রাধান্য দীর্ঘকাল বজায় ছিল।
এরপর পৃথিবীর জনসংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ল। বাড়তি মানুষের জন্য বাড়তি শিকারের প্রয়োজন হলো। এতে পুরুষের গুরুত্ব বেড়ে যায়। সমাজেও পুরুষরা প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করে। এ বিশ্বাসও পোক্ত হতে থাকে, নারীরা শক্ত কাজের উপযোগী নয়। ফলে নারীরা গুরুত্ব হারাতে থাকে।
বিপরীতে পুরুষতন্ত্রের শেকড় তখন আরো গভীরে যেতে শুরু করে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পুরুষকে সব সময়ই প্ররোচিত করেছে নারীর ওপর প্রাধান্য বজায় রাখতে। তবে আধুনিককালে এসে শিক্ষিত হয়ে, সভ্য হয়ে নারীদের পক্ষে কথা বলছেন কেউ কেউ। নারীর অধিকার নিয়ে কাজও করছেন অনেকে। কিন্তু এই সময়ে এসেই নারী-পুরুষে বৈষম্য করছে ইন্টারনেট!
কথাটি অবাক করার মতো হলেও শতভাগ সত্যি। সম্প্রতি জার্মানিভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে এক খবরে জানিয়েছে, আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি তথা কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ভাষা অ্যালগরিদম নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করছে।
ডয়েচে ভেলের খবরে বলা হয়েছে, আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অন্যতম প্রধান ভিত্তিই হলো অ্যালগরিদম। মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, অ্যাপ ইত্যাদি এই অ্যালগরিদমের ভিত্তিতেই কাজ করে। কিন্তু সেটি নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করে।
খবরে বলা হয়, অনলাইনে ‘অফিস কর্মী’র খোঁজ করলে বদ্ধমূল ধারণাগুলোই আরো পোক্ত হয়। অফিস কর্মী মানেই নারী। আর সিইও বা কোম্পানির প্রধান মানেই পুরুষ। প্রচলিত অনুবাদ সফটওয়্যারও শব্দগুলোর এমন মূল্যায়ন করে। বিভিন্ন পেশা সংক্রান্ত নিরপেক্ষ শব্দগুলোকে একটা ছাঁচে ফেলে দেয় ডিজিটাল জগৎ।
দৈনন্দিন জীবনে অ্যালগরিদমের এই একপেশে মনোভাবের মারাত্মক পরিণতি দেখা যায়। এক মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, অনলাইনে পুরুষদের তুলনায় নারীদেরই কম বেতনের চাকরি খোঁজার পরামর্শ দেওয়া হয়।
তবে কজামিস্টানের প্রতিষ্ঠাতা ও অনলাইনের তথ্য নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান পাই ডাটা বার্লিন। এই সহপ্রতিষ্ঠাতা ক্যাটারিনা ইয়ারমুল মনে করেন, দোষটা মোটেই অ্যালগরিদমের নয়। মানুষই সেই অ্যালগরিদম প্রোগ্রাম করে ও তাতে তথ্য ভরে দেয়।
তিনি বলেন, মেশিন লার্নিং প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে আমরা প্রশিক্ষণ দিই বলেই অ্যালগরিদম শিক্ষা নেয়। নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ‘ডিপ লার্নিং’ হোক, অথবা ‘শ্যালো মেশিন লার্নিং’ হোক, তার ফল একই হয়। তথ্য ভরে আমরা তাকে মত স্থির করতে বলি। কিন্তু তথ্যের মধ্যে যদি বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতি অন্যায়ের ছাপ থাকে, তার ভিত্তিতেই অ্যালগরিদম মনস্থির করবে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ধরুন অনুবাদ সফটওয়্যার। লাখ লাখ টেক্সট শিখে সেই সফটওয়্যার সঠিক শব্দ বাছাই করে। কিন্ডারগার্টেনের প্রসঙ্গে যদি শিক্ষকের তুলনায় শিক্ষিকাদের কথা বারবার উঠে আসে, তখন অ্যালগরিদম সেটিকেই স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়।
তিনি জানান, ছবি শনাক্ত করার অ্যালগরিদম ছবির বিশাল তথ্যভাণ্ডার থেকে শিক্ষা নেয়। সেখানে রান্নাঘরে পুরুষদের তুলনায় নারীদের ছবির সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে অ্যালগরিদম রান্নাঘরের সঙ্গে নারীদের যোগাযোগ স্থাপন করে।
ক্যাটারিনা ইয়ারমুল বলেন, তাদের তথ্যের সব উৎস জানা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক সময় জুড়ে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করলে সচেতনভাবে সেগুলো একবার একাধিক মানুষকে দিয়ে খতিয়ে দেখা উচিত। তাতে কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অন্যায় বা ক্ষতিকর কিছু পেলে সরিয়ে দেওয়া উচিত।
অ্যালগরিদমের কোড বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চরম গোপনীয়তার বেড়াজালে থাকে। তাই কোনো অ্যালগরিদম অন্যায় আচরণ বা বৈষম্য করছে কি না, তা প্রমাণ করা কঠিন।
ডয়েচে ভেল বলছে, টেমিস নামে এক সফটওয়্যার অ্যালগরিদম পরীক্ষা করে বৈষম্য শনাক্ত করতে পারে। ভুয়া অ্যাকাউন্ট সৃষ্টি করে সেটির আচরণ যাচাই করে প্রাথমিক তুলনা করে। লিঙ্গ ছাড়া সেসব অ্যাকাউন্ট হুবহু আসলের মতো।
ইয়ারমুল বলেন, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও সততা মেশিন লার্নিংয়ের ভবিষ্যৎ। অ্যালগরিদমকে বিশ্বস্ত করে তুলতে হব। সেটি কীভাবে কাজ করে, কী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়- মানুষকে এসব প্রশ্ন করার অনুমতি দিতে হবে।
তিনি বলেন, অ্যালগরিদম যে একপেশে আচরণ করতে পারে, এ বিষয়ে এক সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে চাই মানুষের নিয়ন্ত্রণ।