আ.লীগ মাঠে বিএনপি কোর্টে

হাইকোর্টে গতকাল আগাম জামিন নিতে আসা বিএনপি নেতাকর্মীদের একাংশ

ছবি : বাংলাদেশের খবর

রাজনীতি

আ.লীগ মাঠে বিএনপি কোর্টে

  • সাঈদ আহমেদ
  • প্রকাশিত ৩০ নভেম্বর, ২০১৮

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট আগামী ৩০ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র দাখিল হয়েছে গত ২৮ নভেম্বর। প্রতীক বরাদ্দের আগেই নির্বাচনী মাঠে প্রত্যাশীরা। আনুষ্ঠানিক প্রচারণার বাঁশি না বাজলেও ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা করছেন নানাভাবে তারা। ‘নির্বাচনী আচরণবিধিরও লংঘনের তোয়াক্কাও করছেন না অনেকে। প্রচারণা শুরুর আগে বিশ্লেষকদের প্রশ্ন ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’। আ.লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রার্থীরা ভোটের মাঠে বিশেষ আনুকূল্য পাচ্ছেন বলে অভিযোগ বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টের। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা এখনো সরকারি প্রটোকল নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। অন্যদিকে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী এবং দলের নেতৃত্বাধীন ২০ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। আইনের ঘেরাটোপে ইতোমধ্যেই অনিশ্চিত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, দলটির চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ হেভিয়েট অনেক নেতার প্রার্থিতা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা কোনোভাবেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের লক্ষণ নয়। সংবিধান অনুযায়ী, দুর্নীতির দায়ে ২ বছর বা তার বেশি সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাজা সর্বোচ্চ আদালতে বহাল থাকলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।  একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সাজা খেটে কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর পরবর্তী ৫ বছর নির্বাচনে অযোগ্য বিবেচিত হবেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নৈতিক স্খলনজনিত  কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন ২ বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তি লাভের পর ৫ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।’

সংবিধানের এ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়েই অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম  বলেন,  বিচারিক  আদালতে ২ বছরের বেশি দণ্ডপ্রাপ্ত হলে ওই ব্যক্তি খালাস না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন করতে পারবেন না। খালাস পেলেও খালাসের দিন থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর নির্বাচন করতে পারবেন না। যদিও তার বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, এ ব্যাখ্যা সঠিক নয়, বরং বিভ্রান্তি ছড়াবে। তবে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যকে ‘সঠিক’ বিবেচনা করে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা এখন প্রশ্নের মুখে। তিনি বগুড়ার ২টি এবং ফেনীর একটি আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও ইসিতে প্রার্থিতা টেকে কি না সেটি দেখার অপেক্ষায় রয়েছে দলটি। একই অবস্থা আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের অনেক নেতার। আগের নির্বাচনগুলোয় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আ.লীগ নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীর, ঢাকার হাবিবুর রহমান মোল্লাসহ অনেকে নির্বাচন করার সুযোগ পেলেও এবার আইনের ঘেরাটোপে অনিশ্চিত হয়ে গেল দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির শীর্ষ ব্যক্তির প্রার্থিতা। অর্থ পাচার এবং একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দণ্ডিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। দেশে ফিরে নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছেন না। এটিও আইন-আদালতজনিত বিষয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং দলটির মনোনয়ন বোর্ডের অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ৩ বছর দণ্ডিত হলেন ১৭ বছর আগে দায়ের হওয়া একটি মামলায়। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ও জামিন পেয়ে ২৮ নভেম্বর কারামুক্ত হলেও প্রার্থিতা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে তারও। এ কারণে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে কুমিল্লা-৩ থেকে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন স্ত্রী সাহিদা রফিক। বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী  এম মোরশেদ খান, মীর নাসিরউদ্দিন, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, আমানউল্লাহ আমান, তার স্ত্রী সাবেরা আমান, ঝিনাইদহ বিএনপি নেতা ও সাবেক এমপি মশিউর রহমান, মো. আবদুল ওহাব, খাগড়াছড়ি বিএনপির নেতা ও সাবেক এমপি ওয়াদুদ ভুঁইয়া, বিএনপি নেতা অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছেন না। এম মোরশেদ খান ও ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরকে হাইকোর্ট খালাস দিলেও রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এদিকে মনোনয়নপত্র দাখিলের পর গ্রেফতার অব্যাহত রাখা হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে খায়রুল কবির খোকনকে। বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলায় নরসিংদী আদালতে  জামিন চাইলে আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ মামলায় তিনিসহ আসামি ৩৪। নরসিংদী-১ আসন থেকে তিনি বিএনপি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দেন। আর গত ২৭ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর পরই গ্রেফতার করা হয় ঢাকা-৭ আসনে বিএনপির প্রার্থী  মোশাররফ হোসেন খোকনকে। ডিবি পুলিশ রাজধানীর বাটা সিগনাল মোড় থেকে তাকে গ্রেফতার করে। তার পরিবার নির্বাচনের আগেই তাকে  জামিনে মুক্ত করার জন্য ঘুরছে আদালতের বারান্দায়। 

বিএনপির সূত্র বলছে, গত সাড়ে ৯ বছরের শাসনামলে হাজার হাজার মামলা হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। দুর্নীতি মামলা, হামলা, অগ্নিসংযোগ, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ বিভিন্ন উপলক্ষে এসব মামলা হয়েছে। অর্থ আত্মসাৎ, জালিয়াতি-প্রতারণা এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে দুদকও। বিপুলসংখ্যক মামলার পাশাপাশি আরো ৪ হাজারের বেশি গায়েবি মামলা দেওয়া হয়। কল্পিত ঘটনার বিপরীতে এসব মামলা হয়। এসব মামলার আসামির তালিকা থেকে মৃত ব্যক্তি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী, কর্মস্থলে অবস্থানকারী পেশাজীবীও বাদ যাননি। এসব মামলায় জামিন নিতে কথিত আসামিরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন উচ্চ আদালতে। বিএনপিপন্থি সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধে ‘নাশকতা’র অভিযোগে গায়েবি মামলা হয়েছে ১০টি। সিনিয়র সাংবাদিক ও ‘দৈনিক বাংলাদেশের খবর’র উপদেষ্টা সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহউদ্দিনের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। এজাহারে যে সময়কার ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সে সময় তিনি ছিলেন মতিঝিলস্থ নিজ কার্যালয়ে। তাকেও জামিন নিতে হয়েছে হাইকোর্ট থেকে। গায়েবি এ রকম একাধিক মামলায় আসামি করা হয় চিকিৎসক নেতা এজেডএম জাহিদ হোসেন, শিক্ষক নেতা সেলিম ভুঁইয়াকে। ১৫টি নাশকতা মামলায় আসামি করা হয় বিএনপি নেতা কফিলউদ্দিনকে।

সুপ্রিম কোর্ট বার সূত্র জানায়, গত দু’দিনে (বুধ ও বৃহস্পতিবার) গায়েবি মামলার আসামি হিসেবে ঢাকার ৩০, ঠাকুরগাঁওয়ের ১০০, রংপুরের ৭০, চট্টগ্রামের  ৮০, ভৈরব থানার ৪৬, কুমিল্লা দক্ষিণ সদর থানার ২৩ ও মুরাদনগর থানায় শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মীর জামিন হয়েছে। অ্যাডভোকেট সাগির হোসেন লিওন জানান, শুধু আমার চেম্বার থেকেই প্রতিদিন গড়ে ৭০-৮০ জনের জামিন আবেদন করতে হচ্ছে। গায়েবি মামলায় নড়াইলের ১০০, রংপুরের ৭০ এবং ঢাকার ৩০ জনসহ ২০০ নেতাকর্মীর জামিন করিয়েছি।

অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল দোহার ও নবাবগঞ্জ থানায় দায়ের হওয়া পৃথক নাশকতার ৪ মামলায় বিএনপি নেতা খন্দকার আশরাফ, আবদুর রহিম মিয়া, শাহাবুদ্দীনসহ ২৫০ জন এবং বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার ২ মামলায় ৬০ বিএনপি নেতাকর্মীর জামিন করান। সুপ্রিম কোর্ট বারের বারান্দা, আইনজীবীদের কক্ষ, হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ, হাইকোর্ট এনেক্স ভবনের জামিন প্রত্যাশী শত শত মানুষের ভিড় লক্ষ করা গেছে গতকাল বৃহস্পতিবারও। 

গায়েবি মামলার জামিন সম্পর্কে বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ‘বাংলাদেশের খবর’কে বলেন, সরকারদলীয় প্রার্থীরা যখন মাঠে বীরদর্পে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন বিএনপি নেতারা তখন দিনের পর দিন আদালতে জামিনের জন্য ঘুরছেন।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads