আবাহনী-মোহামেডানে বিভক্ত ছিল দেশ

মাঠের এই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ত মাঠের বাইরেও

ছবি : সংরক্ষিত

ফিচার

আবাহনী-মোহামেডানে বিভক্ত ছিল দেশ

  • সৈয়দ মিজান
  • প্রকাশিত ২৫ জুন, ২০১৮

সত্তর ও আশির দশককে বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা চলে। সে সময়ের বাংলাদেশ ফুটবল লিগের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল আবাহনী ও মোহামেডানের দ্বৈরথ দেখার জন্য খেলার মাঠের গ্যালারিগুলো যেমন ছিল দর্শকদের ভিড়ে পরিপূর্ণ, ঠিক তেমনই এই খেলার রেডিও ধারাবিবরণী এবং টিভি পর্দায় সেই খেলার সরাসরি সম্প্রচার দেখার জন্য গ্রামগঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় মানুষের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। ৯০ মিনিটের সেই খেলার সময়টিতে সমগ্র বাংলাদেশ যেন থমকে যেত। বাংলাদেশের মানুষ আবাহনী ও মোহামেডান- এই দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ত।

এই খেলার জন্য দেশের মানুষ এতই আবেগতাড়িত হতো যে, পছন্দের দল না জিতলে বিপক্ষ দলের সমর্থকদের সঙ্গে হাতাহাতি থেকে শুরু করে অনেক সময় ভয়ঙ্কর সংঘাতে রূপ নিত। মানুষ এতটাই ফুটবল অনুরাগী ছিল যে, সে সময় নাকি কোনো কট্টর আবাহনী সমর্থকের মেয়ের সঙ্গে কোনো কট্টর মোহামেডান সমর্থকের ছেলের বিয়ে কল্পনাই করা যেত না।

১৯৮২ সালে মাঠে মারামারির ঘটনার সূত্র ধরে বড় রকমের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে আবাহনী ক্লাবের চার খ্যাতিমান তারকা ফুটবলার জেলে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া দুটো মর্মান্তিক ঘটনার কথা আজো অনেকের মনে দাগ কাটে। খেলা নিয়ে মারামারির সূত্র ধরে ১৯৮০ ও ১৯৮৫ সালে প্রাণ হারিয়েছিলেন তিন ফুটবলপ্রেমী।

সে সময়ে মোহামেডান ও আবাহনী- এ দুটি প্রধান দলের পেছনেই ছিল শতকরা ৯০ ভাগ সমর্থক। তাদের লড়াই ছিল খুব মর্যাদাপূর্ণ। দু’দলের সাফল্যের মূল নিয়ামক ছিল মর্যাদাপূর্ণ এই লড়াইয়ের ফল। তখনকার ফুটবলারদের মানও ছিল অনেক উন্নত। মোহামেডান দলে তখন খেলতেন কায়সার হামিদ, বাংলার ম্যারাডোনা খ্যাত সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির, কানন, নকিব, জনি, জুয়েল রানা, মানিক, পনিরসহ দেশখ্যাত সব খেলোয়াড়। বিদেশি খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন এমেকা, নালজেগার, নাসের হেজাজী, রাশিয়ান রহিমভ, ইরানিয়ান আরেক সুপারস্টার ভিজেন তাহিরি। এসব কৌশলী খেলোয়াড়ের ক্রীড়ানৈপুণ্য ছিল সত্যিই দেখার মতো। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত পরপর তিনবার অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় ‘আনবিটেন হ্যাটট্রিক’-এর রেকর্ড গড়ে সাদা-কালো জার্সিধারী মোহামেডান।

এদিকে, আবাহনীতে খেলতেন দেশসেরা ডিফেন্ডার মোনেম মুন্না, স্ট্রাইকার আসলাম, গাউস, রেহান, এফ আই কামাল, মহসিন, রুপুসহ অনেকে। বিদেশি খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন ইরাকের বিশ্বকাপ স্কোয়াডের দুই খেলোয়াড় করিম মোহাম্মদ ও সামির সাকির, শ্রীলঙ্কার লায়নেস পিরিচ, পাকির আলী, প্রেমলাল এবং রাশিয়ান দজমরাভ। ’৮৪, ’৮৫ ও ’৮৬ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন হয়ে হ্যাটট্রিক শিরোপা লাভ করে আবাহনী। তারা ১৯৮৯-৯০ সালে ভারতের গেরিলায় নাগজি কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে এবং ১৯৯৪ সালে কলকাতায় চার্মস কাপ ইনভাইটেশন কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। এ ছাড়াও আবাহনী ১৯৯১ সালে দুই বাংলার সেরা ছয় দল (ভারতের ইস্ট বেঙ্গল, মোহনবাগান, কলকাতা মোহামেডান, বাংলাদেশের মোহামেডান, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও আবাহনী) নিয়ে অনুষ্ঠিত বিটিসি ক্লাব কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের জন্য সম্মান বয়ে নিয়ে আসে।

খেলার আগের দিন থেকেই ঢাকার অলিগলি এবং বাড়িতে বাড়িতে প্রিয় ক্লাবের পতাকা ওড়াতো সমর্থকরা। খেলার দিন সকাল থেকেই বাড়িতে সাজসাজ রব পড়ে যেত। প্রিয় দল জিতলে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়া, আনন্দ মিছিল, পতাকা ওড়ানো ইত্যাদি কাজ ছিল নিত্যদিনকার চিত্র।

আজ সেই রামও নেই অযোধ্যাও নেই। একসময়ের বহুল আকাঙ্ক্ষিত ও প্রবল উত্তেজনাময় আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল ম্যাচের আগের আবেদন এখন আর নেই। ঘরোয়া ফুটবলের প্রতি দর্শক নানা কারণে অনেক আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পেশাদার লিগে গত কয়েক মৌসুমে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ হয়েছে নীরবে-নিভৃতে, দর্শকশূন্য মাঠে। এবারো হয়ত তাই হবে। ফুটবলের সেই সুদিন কি আর ফিরবে?

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads