আজ তব কথা নয় কাজ হোক আগে

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

আজ তব কথা নয় কাজ হোক আগে

  • প্রকাশিত ২০ এপ্রিল, ২০২১

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। আর এদেশের সিংহভাগ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। দেশের শতভাগ মানুষ কৃষকের ওপর নির্ভরশীল। যে দেশের কৃষকেরা রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাঠে ফসল ফলিয়ে সারা দেশের মানুষের মুখের অন্ন জোগায়, সে দেশের কৃষকেরা পায় না কোনো মর্যাদা, উৎপাদিত ফসলেরও কোনো ন্যায্যমূল্য দেওয়া হয় না। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই কৃষক। আর এই কৃষকের ওপর ভর দিয়েই উচ্চ পর্যায়ের যাবতীয় যা কিছু সবই সম্পাদন হয়ে থাকে। কোনো এক মহামানবের বাণী সংকলনে দেখেছিলাম ‘যেমন কথা তেমনি কাজে, সেই লোকটা নয়কো বাজে।’ ‘মুখে জানে ব্যবহারে নাই, সেই শিক্ষার মুখে ছাই।’ ‘বলায় পটু কাজে কম, নিজেই কিন্তু নিজের যম।’ এভাবে বাস্তবতার ভিত্তিতে অসংখ্য মূল্যবান নীতিবাক্য সংকলনে দেখেছিলাম। আসলে আমার দেশের শীর্ষস্থানীয় কর্ণধার ব্যক্তিরা ভালো ভালো কথার মালা কৃষকদের গলায় পরিয়ে দিয়ে স্তববাক্যে সান্ত্বনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। আসলে বাংলাদেশের কৃষকদের নিয়ে মুখে মুখে ‘চান্দে ওঠায়া’ সান্ত্বনা দেওয়া হয়। শুধু কথায় নয় কাজে আসুন, দেশের কৃষকদের স্বার্থ দেখুন। তবেই আমার বাংলাদেশ সোনার বাংলায় পরিণত হবে।

তবে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমরা কৃষক সমাজ অনেকটাই বুঝেছি যে, আমাদেরকে নিয়ে আমার দেশের শীর্ষস্থানীয় কর্ণধার ব্যক্তিরা শুধু মশকরাই করে, তা না হলে বিগত আম্পান ঝড়ে বাংলাদেশের কৃষকদের মেরুদণ্ড ভেঙে একেবারেই চুরমার হয়ে যায়। তখনো অনেক কথার ফুলঝুরি শুনেছি। অনেক কৃষি প্রণোদনা, সহজ শর্তে কৃষকদের ঋণের ব্যবস্থা করা, কৃষকদের আর্থিক সহায়তা দান প্রভৃতি। কিন্তু খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায় সবই ‘শুভংকরের ফাঁকি’। আম্পান ঝড়ে বাংলাদেশের কৃষকদের পেঁপের বাগান, কলার বাগান, পানের বরজ, আমবাগান, পেয়ারা বাগান, লিচু, কাঁঠালসহ প্রভৃতি ফসলের ক্ষেত মাটির সঙ্গে মিশে যায়। সিংহভাগ কৃষকের বসতবাড়িও মাটির সঙ্গে মিশে যায়। তদুপরি করোনার প্রভাব। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বছরের পর বছর কৃষকদের ওপর খাঁড়ার ঘা চলতেই আছে। একদিকে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস মহামারী, অন্যদিকে প্রলম্বিত বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ খরা-ঝড় সবকিছু মিলে কৃষকের ওপর প্রাকৃতিক অবিচার সারা বছরই চলতে থাকে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যতগুলো মন্ত্রণালয় আছে, তার মধ্যে সব মন্ত্রণালয় পোক্তভাবে চললেও কৃষি মন্ত্রণালয় যেন সারা দেশের কৃষকদের সুবিধার বিষয়ে উদাসীন। ইচ্ছা করলে কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষকদের অবসরকালীন পেনশন ভাতা প্রবর্তন, ফসলের নিরাপত্তা বীমা, ফসলের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, মৃত্যুর পর পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান, সহজ শর্তে বিনাসুদে ঋণদান, গৃহনির্মাণ ঋণদান, কৃষকদের ছেলেমেয়েদের বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদানসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা প্রদান করতে পারে। সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালার ভেতর দিয়ে এই কৃষিবান্ধব সরকারের আমলে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির পরও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে এসেও কৃষকদের সুনির্দিষ্ট কোনো স্বার্থের ব্যবস্থা হলো না, তাহলে কস্মিনকালেও আর হবে বলে আমাদের মনে হয় না। 

আমাদের দেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ৪৪টি  মন্ত্রণালয় বিদ্যমান। দেশের কতজন নাগরিক এই মন্ত্রণালয়গুলোর নাম জানে ভেবে দেখুন তো! তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নাম প্রায় শতভাগ নাগরিক বলতে পারে বলে মনে হয়। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় দেশের কৃষকদের স্বার্থ নিয়ে অতটা ভাবে বলে মনে হয় না। গত ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় সারা দেশের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া ও তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ায় কৃষকদের বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। হাজার হাজার হেক্টর বোরো ক্ষেতের ধান বাইলে চিটা পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবরে দেখা যায়, ‘আধা ঘণ্টার লু হাওয়ায় কৃষকের স্বপ্নভঙ্গ- ‘গোপালগঞ্জের ৭৮ হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট’ (৭ এপ্রিল, দৈনিক দিনপরিবর্তন)। ‘শার্শায় স্বপ্ন পুড়ে ছাই কৃষকের : ২১ হাজার ৭০৪ হেক্টর জমির ধান নষ্ট’ (১১ এপ্রিল, দৈনিক প্রজন্মের ভাবনা)। ‘রুক্ষ বাতাসে রাজশাহীর ২৮ হেক্টর ধানে চিটা’ (১১ এপ্রিল, দৈনিক জনকণ্ঠ)। ‘নাটোরে কয়েক হাজার হেক্টর জমির ধানে চিটা’ (১১ এপ্রিল, দৈনিক সময়ের আলো)। এভাবে ময়মনসিংহ, ফুলপুর, ভালুকা, মনোহরদী, জামালপুর, দেওয়ানগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, যশোর, বাঘারপাড়া, কালীগঞ্জ, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, কমলগঞ্জ, মৌলবীবাজারসহ সারা দেশের ওপর দিয়েই এই ঝড়ো হাওয়া ও তাপপ্রবাহে হাজার হাজার হেক্টর বোরো ক্ষেতের ধানে বাইলে চিটা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এ বিষয়ে গত ৭ এপ্রিল বুধবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নেত্রকোণার কেন্দুয়ায় ঝড়ো হাওয়া ও তাপপ্রবাহে কৃষকের ক্ষতিগ্রস্ত বোরো ধানের ক্ষেত দেখতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা দেবে।’ কিন্তু কই? দেশের বিভিন্ন জায়গায় বোরো ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করতে কোথাও দেখা যায়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, ‘ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা দেবে।’ এটা কি সারা দেশের কৃষকদের, না-কি শুধু নেত্রকোণার কেন্দুয়ার কৃষকদের সহযোগিতা দেওয়া হবে? আসলে আমার বাংলাদেশের কৃষকদের নিয়ে মুখে মুখে ‘চান্দে ওঠায়া’ সান্ত্বনা দেওয়া হয়। তবে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমরা কৃষক সমাজ অনেকটাই বুঝেছি যে, আমাদের নিয়ে শুধু মশকরাই করা হয়।  তাই আবারো বলতে হয়— শুধু কথায় নয় কাজে আসুন, দেশের কৃষকদের স্বার্থ দেখুন। তবেই আমার বাংলাদেশ সোনার বাংলায় পরিণত হবে।

লেখক : লক্ষ্মণ চন্দ্র মণ্ডল

সাংবাদিক ও  সংগঠক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads