গ্রামাঞ্চলেও দরকার সুপরিকল্পিত উন্নয়ন নীতি

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

গ্রামাঞ্চলেও দরকার সুপরিকল্পিত উন্নয়ন নীতি

  • প্রকাশিত ২০ এপ্রিল, ২০২১

বাংলাদেশ সম্প্রতি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সফলভাবে অতিক্রম করেছে। সেই দীর্ঘ যাত্রায় সফলতা হিসেবে নব মাত্রা দিয়েছে জাতিসংঘ কর্তৃক ‘উন্নয়নশীল’ দেশের চূড়ান্ত সুপারিশ। এটা নিঃসন্দেহে আমোদ এবং প্রশংসার দাবিদার। বর্তমান সরকার খুব দক্ষ হাতে দেশে বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা করেছে, করছে। সেসবের কিছু বাস্তবায়ন হলো পদ্মা সেতু, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি। বাংলাদেশ এখন আর সেই অজপাড়াগাঁয়ের দেশ নয়, এখন এদেশের সর্বত্রই মোটামুটি জুতা পড়ে হেঁটে বেড়ানো যায়। বৃদ্ধি পেয়েছে মাথাপিছু আয়সহ বিবিধ বিষয়। এখন গ্রামে গেলে আর কুঁড়েঘরে হারিকেন জ্বালানো দেখা বিরল কিন্তু গ্রামে গেলে পাকা ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বলা দেখাটা প্রবল। তবু এতসব প্রমোদের মাঝে একটি বিষয় প্রতিনিয়ত গূঢ় অমাবস্যার মতো নেমে এসেছে। সেটা হচ্ছে প্রতিনিয়ত গ্রাম থেকে বিরাট একটা অংশ উন্নত জীবন ও ভালো আয় করার বাসনা নিয়ে শহরমুখী হচ্ছে।

গ্রামে সাধারণত যেসব সমস্যা হয়, তার কয়েকটি কারণ হলো মৌলিক অধিকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান। বাসস্থানের কথা বলার কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ। প্রতি বছর সেসব নদীর পাড় ভাঙছে আর ভিটাহীন হয়ে যাওয়ার কারণে কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তাঁরা শহরে গিয়ে বস্তিবাসী হওয়া ছাড়া অন্যথা কোনো উপায়ান্তর থাকে না। আবার যেসব মানুষ গ্রামে কোনোক্রমে বাস করছে, তাদের মধ্যে যাদের স্বাস্থ্যজনিত বিবিধ সমস্যা দেখা দেয়, ওরা ভালো চিকিৎসাসেবার জন্য অনেকে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। তাছাড়া ক্রমেই গ্রামে কৃষির প্রতি উদাসীনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কাজকর্ম ব্যাপকহারে হ্রাস পাচ্ছে, বিশাল একটি অংশ আয় করার জন্য বিশেষ করে ঢাকামুখী হচ্ছে। ফলে রাজধানী ঢাকা এদের চাপ সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। 

কৃষি ক্ষেত্রে, দেশের যেসব বোরোপ্রধান এলাকা আছে সেসব অঞ্চলে প্রতিবছর একটা চক্রাধীন কাজ চলে। যেমন : যখন বর্ষা মৌসুম আসে তখন আগের বছর যেসব দুর্বল বাঁধ দেওয়া হয়, সেসব বাঁধ প্রবল পানির চাপে ভেঙে লাখ লাখ মানুষের ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। অন্যদিকে, পানির ঢলে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় আরেকদল আগের বছর থেকে যেসব মৎস্য চাষ করছিল তাদের মৎস্যগুলো অবাধে পুরো হাওরে ছড়িয়ে পড়ে। এতে জেলেদের বিরাট আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। ফলে দুপক্ষই সরকারের প্রকল্পের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমতে থাকে। সরকার আবার সেই ক্ষোভ উপশম করতে বছর ঘুরতেই বাঁধ পুনঃসংস্কারের তাগিদে পদক্ষেপ নেয়। এতে সরকার হাওর এলাকায় টেকসই কাজ করাতে ব্যর্থ হয়। এভাবে উন্নয়ন কতটুকু সম্ভব তা প্রশ্নবোধক চিহ্নের সম্মুখীন।

যারা তখন ফলন ঘরে তুলতে পারে, তারা যখন সেসব ফলন বিক্রি করতে চায় তাদের আবার বিরাট মাশুল গুনতে হয়। যেমন দেশের সর্বত্র নদী থাকা সত্ত্বেও অনেক নদী এখন নাব্য সংকটে বা দখলদারিত্বের করাল গ্রাসে। সেক্ষেত্রে কৃষকদের কিছু অংশ নৌ এবং কিছু সড়কপথে নির্দিষ্ট গন্তব্যে প্রেরণ করতে হয়। মাঝদিয়ে পণ্য ওঠানামা করাতে চড়া হিসেবে শ্রমিক মজুরি পরিশোধ করতে হয়।

হাওর এলাকায় আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, সরকার যখন বাঁধ তৈরি করে, সেখানে কিছু কিছু স্লুইস গেট করে, সেটার পেছনে কিছু উদ্দেশ্য থাকে। সাধারণত যখন হাওরে ফলন উত্তোলন শূন্যের কোটায় চলে আসে, তখন হাওরে পানি প্রবেশের জন্য ওই গেটগুলো খুলে দিতে হয় যাতে হাওরে পর্যাপ্ত পানি ঢোকার সাথে সাথে নদীর প্রবাহ অতি উর্বর পলিমাটিসমৃদ্ধ বিশাল জলরাশি প্রবেশ করতে পারে, যার ফলে পরবর্তী বছরে বাম্পার ফলন হয় আবার নদীতে যাতে অত্যধিক পরিমাণে পানি ফুলে-ফেঁপে না ওঠে এবং দুজায়গার হরেক মাছ স্থান বদল ও বিপুল পরিমাণ মৎস্য আহরণ করতে সক্ষম হয়। বাস্তবে যা হয় তা হলো সেই ফলনের পাশাপাশি যারা হাওরে অন্যান্য ফার্ম করেন, তাদের পর্ব অসমাপ্ত হওয়ায় তারা ‘স্লুইস গেট’ খুলে দিতে ‘অপারগতা’ প্রকাশ করেন। হিতে, নদীর পাড়কেন্দ্রিক যেসব হাটবাজার, বসতি আছে সেসব জলে নিমজ্জিত হয়ে যায়। এর ফল খোদ সরকারকেই ভুগতে হয় কারণ পরবর্তী বছরে ওসব হাট-বাজারবাসী আবার এলাকার পুনঃসংস্কার দাবি করে।

আমাদের দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই কিন্তু এসব উন্নয়নমূলক কাজে সাধারণ জনগণকে আরো সম্পৃক্ত করতে হবে। সাধারণ মানুষের রোজগারের পথ বর্ধন সাধনের জন্য গ্রামীণ এলাকায়ও হালকা কিংবা মাঝারি মানের শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা আয়ের পথ সুগম করার জন্য কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ বিশ্বের মাঝে যেভাবে বিনিয়োগের অন্যতম কান্ডারি হয়ে উঠছে, তাতে গ্রামীণ এলাকায় বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করা খুব কষ্টসাধ্য হবে বলে মনে হয় না। আবার সেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে যাতে পর্যাপ্ত দক্ষ জনশক্তি পায়, সেজন্য দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে উপযুক্ত ভালো মানের পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে হবে, যাতে তারা ওসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গেলে প্রত্যাখ্যাত না হয়। আবার ওসব মানুষ অসুস্থ হলে প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সরকারি ২০ শয্যা বা তদূর্ধ্ব শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ভালো মানের চিকিৎসা নিতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এতসব অবকাঠামো বিনির্মাণে একটু সুপরিকল্পনা দরকার। আমাদের দেশের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনাবিদদের মাঝে প্রায়ই একটা আলোচনা থাকে যে উন্নয়ন পরিকল্পিত হচ্ছে না। তাছাড়া গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চলের মাঝে উন্নয়ন বৈষম্য না করার জন্য দেশের সংবিধানে ‘গ্রামীণ ও কৃষি বিপ্লব’ নামের ১৬ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে- ‘নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগত দূর করিবার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকীকরণ ব্যবস্থা, কুটিরশিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ তাই যতদ্রুত পারা যায় সরকারকে অনতিবিলম্বে এ অনুচ্ছেদের বাস্তবায়ন করতে হবে।

বোরোপ্রধান এলাকায় স্থায়ী ও টেকসই প্রকল্প হাতে নিতে হবে যাতে এক এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজ সমাপ্ত হলে অন্য এলাকায় দ্রুত আরেকটি উন্নয়নমূলক কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়। অন্যদিকে, দেশে যে হারে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে ক্রমশ মানুষ নৌপথে যোগাযোগ করার প্রয়াস শূন্যতে আসতে শুরু করেছে। এজন্য দেশের ‘সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়’ এবং ‘নৌ মন্ত্রণালয়’-কে কাজের ক্ষেত্রে সমন্বয় করে একচ্ছত্রভাবে ও নিরবচ্ছিন্নভাবে যেন কাজ করতে পারে এবং সেসব কাজের ফলে যেন সাধারণ মানুষ উপকৃত হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

যেহেতু বাংলাদেশ অতি দুর্যোগপ্রবণ দেশ তাই দেশের প্রায় সব গ্রামীণ এলাকায় উন্নত খাদ্য গুদাম, দুর্যোগ প্রতিরোধ কেন্দ্র প্রস্তুত করে রাখতে হবে যাতে যেকোনো সময়ই ওসব ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া যেহেতু শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছি এজন্য এবং স্থানীয়দের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে হবে। একটা এলাকায় যত বেশি নিরাপত্তা জোরদার করা যাবে দেশে তখন অপরাধের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকবে। ফলে আমাদের সবদিক বিচার-বিবেচনা করে এবং জলবায়ু তথা সবুজায়নের কথা মাথায় রেখে স্থাপনা তথা প্রকল্প হাতে নিতে হবে। একটা উন্নয়ন কাজের জন্য যথোপযুক্ত ‘বাস্তুতন্ত্র’ যাতে বিলুপ্তির পথে না বসে সেজন্য কৃষি ও মৎস্য সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। পরিশেষে আমাদের লক্ষ্য থাকা উচিত একটি উন্নয়ন প্রকল্প সম্পন্ন করতে গিয়ে মানুষ তথা প্রাণিজগতের কোনো জীবেরই যেন পৃথক কোনো সমস্যা দেখা না দেয়।

লেখক : রিপন চন্দ্র পাল

শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads