আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘বিচার শাখা-৭’ থেকে দুই শতাধিক নথি গায়েব হয়ে গেছে। গায়েব হওয়া এসব নথি নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) নিয়োগ সংক্রান্ত। নথি না থাকায় সংশ্লিষ্ট দফতরের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে মূল নথি এমনকি অনুলিপিও সরবরাহ করতে পারছে না। নথি ছাড়া রুলের জবাব দাখিল করায় সেই জবাবও থাকছে অসম্পূর্ণ। এতে উচ্চ আদালতে বছরের পর বছর ঝুলে থাকা নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ সংক্রান্ত শত শত মামলার কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
সলিসিটর অনুবিভাগ এবং আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ সংক্রান্ত মূল নথি বা রেকর্ডপত্র খুঁজে না পাওয়ার কারণে একতরফা নিষ্পত্তির দিকে যাচ্ছে মামলা, যার সুফল পাচ্ছে জালিয়াত চক্র এবং ভুয়া নিকাহ রেজিস্ট্রাররা।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বহিরাগত একাধিক চক্র জাল-জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিচার শাখা-৭-এর সিনিয়র সহকারী সচিব বুলবুল আহমেদ বলেন, আমি কয়েক মাস হলো এই দফতরে যোগ দিয়েছি। সচিব সাহেবের অনুমতি ছাড়া কিছু বলতে পারব না। এটুকু বলতে পারি, আমার দফতর থেকে কোনো নথি গায়েব হয়নি।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আইন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সেবাধর্মী একটি দফতর ‘বিচার শাখা-৭’। এ কারণে দফতরটি বাংলাদেশ সচিবালয় সুরক্ষিত কম্পাউন্ডের বাইরে পরিবহন পুল ভবনে রাখা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অধীন নিবন্ধন সংক্রান্ত ডেস্কটি এখানে। সাব-রেজিস্ট্রার, নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) নিয়োগ, বদলি, বরখাস্ত, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ. কাবিন ও তালাকনামা অনুবাদ, সত্যায়ন, এফিডেভিট ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পাদিত হয় এ দফতর থেকে। এ সুযোগে দফতরটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে কর্মকর্তা-বহিরাগত সমন্বয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। দফতরে কর্মরত কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার পৃষ্ঠপোষকতায় সক্রিয় রয়েছে এসব চক্র। চক্রের সদস্যদের কারসাজিতেই নিমিষে গায়েব হয় নিয়োগ এবং মামলা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি।
সূত্রমতে, নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ সংক্রান্ত রিটে আইন সচিবকে বিবাদী করা হয়। এ কারণে রুলের জবাবগুলো দাখিল হয় আইন সচিবের স্বাক্ষরে। তবে জবাবগুলো তৈরি হয় মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘বিচার শাখা-৭’ এ। গত কয়েক মাসে নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ সংক্রান্ত রিটের ১১ রুলের জবাব দেয় এ দফতর। এর মধ্যে অন্তত ৩টি জবাব সিনিয়র সহকারী সচিব জিএম নাজমুছ শাহাদাৎ’র ফরোয়ার্ডিংসহ দাখিল হয়। তিনি বদলি হয়ে যাওয়ার পর ৮টি জবাব দাখিল করেন সিনিয়র সহকারী সচিব বুলবুল আহমেদ। এর মধ্যে একটি রিট (নং-১৪২১০/২০১৬) মো. মাহবুবুর রহমান খানের। তার রিট এবং রুলের দফাওয়ারি জবাবে আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৭ থেকে বলা হয়, সরকার বিবাহ রেজিস্ট্রি সহজীকরণ, রেজিস্ট্রিবিহীন বিবাহের প্রবণতা রোধকরণ এবং জনস্বার্থে আইন ও বিধিমালা মোতাবেক নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ প্রদান করে থাকেন। পিটিশনার মো. মাহবুবুর রহমান খানকে অস্থায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিধি মোতাবেক স্থায়ী নিয়োগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্থায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রি লাইসেন্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হইয়া যাইবে। কাজেই সরকারের নিয়োগ কার্যক্রম সঠিক রয়েছে।
গত ৯ মে হাবিবুর রহমানের দায়ের করা আরেকটি রিটের (নং-১৩৭০২/২০১৭) জবাব দেন সিনিয়র কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ। এটিতে তিনি বলেছেন, ‘স্মারক নম্বর ১৪৬৫ থেকে ১৮০১-এর মধ্যে ১৭৯৫ নম্বর স্মারকটি হাবিবুর রহমানের নামে ইস্যুকৃত মর্মে ইস্যু রেজিস্ট্রারে পাওয়া গেলেও উল্লিখিত ইস্যুর সমর্থনে কোনো ফাইল/নোটশিটের অস্তিত্ব অত্র বিভাগে নেই।’ অর্থাৎ নথিগুলো এক সময় ছিল কিন্তু এখন নেই। উল্লিখিত স্মারক নম্বরগুলোর আওতায় ২ শতাধিক নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ সংক্রান্ত নথি রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব নথির ভিত্তিতেই ইতঃপূর্বে জিএম নাজমুছ শাহাদাৎ’র ফরোয়ার্ডিংসহ রুলের জবাব দাখিল করা হয়েছে। অন্যদিকে ১৫৫৬০/ ২০১৬ ১৫৬১১/ ১৬,১৪৮২০/ ১৬,১৪৮২১/ ১৬,১২৪/ ১৭,৫৭০/১৭ নম্বর রিটের জবাবে একই দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ তার ফরোয়ার্ডিংয়ে কোথাও বলছেন ‘সরকারের নিয়োগ কার্যক্রম সঠিক রয়েছে।’ কোথাও বলছেন, ‘ফাইল/ নোটশিটের অস্তিত্ব অত্র বিভাগে নাই’ কিংবা ‘উল্লিখিত স্মারকটি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজন করা হয়েছে’। একই ধরনের রিটে একেক রুলের জবাবে একেক রকম তথ্য দিচ্ছেন। যে তথ্য জালিয়াতচক্রকে আরো জটিলতা সৃষ্টির সুযোগ করে দিচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ‘বিচার শাখা-৭’-এর একজন কর্মকর্তা জানান, ১৪৬৫ থেকে ১৮০১ স্মারকের মধ্যে ২ শতাধিক নিকাহ রেজিস্ট্রারের নিয়োগ সংক্রান্ত নথি রয়েছে। এ নথিগুলোর ভিত্তিতেই অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া নিকাহ রেজিস্ট্রারদের ‘নিয়োগ সঠিক’ মর্মে রিটের জবাব দেওয়া হয়। অথচ নথিগুলোর অস্তিত্বই বর্তমানে বিচার শাখা-৭-এর দফতরে নেই-মর্মে জানাচ্ছেন বর্তমান সিনিয়র সহকারী সচিব। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ সংক্রান্ত নথিগুলো বিচার শাখা-৭ এর সিনিয়র সহকারী সচিবের জিম্মায় থাকে। নথির নিরাপত্তাসহ সকল দায়-দায়িত্বও তার। তাই নথি খুঁজে পাওয়া-না পাওয়ার দায়ভারও ওই কর্মকর্তার।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন বিচার শাখা-৭ নানামুখী দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। তদবিরকারক ও দালালচক্র এখানে সারাক্ষণই ভিড় করে থাকে। তারা এখানকারই এক শ্রেণির কর্মকর্তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জাল-জালিয়াতি করছেন। গায়েব করে দিচ্ছেন ফাইলও। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার সতর্ক করা হলেও সেটির প্রতিফলন নেই এই দফতরে।
জানা গেছে, সচিবের দফতরের একজন কর্মচারী এবং বিচার শাখা-৭-এর দু’জন কর্মকর্তা দালাল-জালিয়াতচক্রের অভিভাবক। তারা কখনো আইনমন্ত্রী, কখনো সচিবের নাম ভাঙিয়ে ‘কার্য’ সম্পাদন করেন। এ সিন্ডিকেট ভাঙা না গেলে মন্ত্রণালয়ের এই দফতরটি দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব নয়-মর্মে অভিমত দেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা।